ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বিচার বিভাগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
বিচার বিভাগ

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন। আর এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান দায়িত্ব বহন করে বিচার বিভাগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন সময়। এ অবস্থায় বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নির্ভীক ও জনমুখী করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। হাইকোর্ট সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পূর্বের (১৯৭২ সালের) অবস্থায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠারও নির্দেশ দিয়েছেন। এই রায় দেশের বিচারব্যবস্থা এবং সামগ্রিক শাসনব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।

উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়, যা পরবর্তীকালে নানা সংশোধনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদে রূপ নেয়। এই অনুচ্ছেদের ফলে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কার্যত নির্বাহী বিভাগের হাতে চলে যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করত। এ অবস্থার পরিবর্তন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী ২০২৪ সালে রিট করেন, যার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। 

এই রায়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তিন মাসের মধ্যে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; যা ‘তিন বিভাগের’ মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, যা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা বাড়াবে।

এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি আইনি রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি নৈতিক এবং সাংবিধানিক বার্তা বহন করে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ নয়, বরং স্বাধীন এবং সমতুল্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ, কোনো দেশের প্রকৃত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন কেবল তখনই প্রতিষ্ঠা পায়, যখন বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।

আমরা আশা করি, সরকার হাইকোর্টের এই রায়কে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এতে করে বিচার ব্যবস্থায় গতি আসবে, বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পেতে আত্মবিশ্বাসী হবে এবং সর্বোপরি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে।

আইনের শাসন মানে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয়, বরং সেই আইন সঠিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। বিচার বিভাগ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে আইনের শাসন কখনোই কার্যকর হবে না। দুর্নীতি, পক্ষপাতদুষ্ট রায় ও বিচার বিলম্ব এই শাসনের পথের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা মনে করি, একটি সুশাসিত রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ অপরিহার্য। বিচারকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, বিচার বিলম্ব নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা সময়ের দাবি। বিচারব্যবস্থাকে জনআস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান থাকবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করুন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে, একটি কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলুন। যেন প্রতিটি নাগরিক ন্যায়বিচার পায় এবং সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।