ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

হাতকড়া-শিকল পরিয়ে  আরও ৩০ বাংলাদেশিকে  ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫, ১২:২৯ এএম
যুক্তরাষ্ট্র

বৈধ নথিপত্র ছাড়া বসবাসের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার রাতে তাদের বহনকারী বিশেষ ভাড়া করা উড়োজাহাজ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। রানওয়ে পর্যন্ত শিকল বেঁধেই তাদের আনা হয়েছে। রানওয়ে থেকে শিকল খুলে অ্যারাইভাল গেটে নেওয়া হয়। এ সময় কাউকে তাদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। কাউকে কোনো ধরনের ছবিও তুলতে দেওয়া হয়নি। তাদের মধ্যে একজন নারীও আছেন।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) মোয়াজ্জেম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, একজন নারীসহ ৩০ জনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের বহনকারী উড়োজাহাজ গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিমানবন্দরে এসেছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাত ১১টার পর উড়োজাহাজটি অবতরণ করলেও তিন ঘণ্টা সেটি রানওয়েতে ছিল। সেখানে আরোহীদের হাতকড়া ও শিকল খোলা হয়, বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল এরিয়ায় পৌঁছানোর আগেই সবাইকে শিকলমুক্ত করে দেওয়া হয়। রাত ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের বিমানবন্দরে আনা হয়। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ টিম, কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ টিম এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

দীর্ঘ যাত্রা ও শিকল পরে থাকার কারণে আগতরা ছিলেন বিধ্বস্ত। ওই সময় নোয়াখালীর ২২ বছর বয়সি আব্দুল্লাহ বিমানবন্দরে হতাশা প্রকাশ করে বলতে থাকেন, এই লম্বা যাত্রায় পুরোটা সময় হাতে-পায়ে দাগি আসামির মতো শিকল পরিয়ে রেখেছিল। একে তো দেশে ফেরত আসার হতাশা, তার ওপর ‘টেররিস্টের’ মতো হাতে-পায়ে শিকল পরে মাতৃভূমিতে ফেরার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কারো যেন না হয়!

বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক মাসে অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আসার তথ্য জানা গেছে।

প্রথম দিকে হাতকড়া ও শিকল পরানো না হলেও গত ২ আগস্ট একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭-এ করে নারীসহ যে ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়, তাদের সবার হাতকড়া ও শিকল ছিল। গতকালও সবার হাতে হাতকড়া ও শিকল পরানো ছিল।

ফেরত আসা ব্যক্তিরা জানান, প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় তাদের হাতকড়া ও শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। খেতে দেওয়া হয়েছে শুধু রুটি আর পানি। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময় শিকল খুলে দিয়ে একজন অফিসার সঙ্গে যেতেন, টয়লেট সারার পর আবার শিকল বেঁধে দিতেন।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও এইচএসআইএর ইমিগ্রেশন বিভাগের সূত্র বলছে, এর আগে চলতি বছরের ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। এর আগে চলতি বছরের ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক ফ্লাইটে আরও অন্তত ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা ১৮০ ছাড়িয়েছে।

মার্কিন আইন অনুযায়ী, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার কারণে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটের ব্যবহার বেড়েছে।

এর আগে ২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। তারা বিশেষ ফ্লাইটে এসেছিলেন, আর যাত্রাপথে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এই দৃশ্য তখন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এভাবে শিকল পরানোয় মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শিকল পরানো উচিত নয়। সাধারণ অভিবাসীদের হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ-ের পরিপন্থি।

অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ অভিবাসী হতে চাইবেন, এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামী দিনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।