সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা ও সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে টানা দুই দিন ধরে জেন-জিদের বিক্ষোভ আর সহিংসতায় ১৯ জন নিহতের পর গতকাল মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেল। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের আগেই পদত্যাগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্টের পদত্যাগে নেপাল সরকারের পতন হলো।
এদিকে নেপালের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, পদত্যাগ করার আগেই সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ওলি এবং পরিস্থিতির অবনতিশীলতার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধও করেন।
খবরে আরও দাবি করা হয়, ওলির অনুরোধের জবাবে জেনারেল সিগডেল বলেন, তিনি (ওলি) ক্ষমতা ছাড়লেই কেবল সেনাবাহিনী দেশকে স্থিতিশীল করতে পারবে। সেনাবাহিনীর সূত্র গণমাধ্যমকে আরও জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ওলি পদত্যাগ করার পর সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে প্রস্তুত। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ খবর নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নেপালে রাষ্ট্রপতি সরকারপ্রধান আর প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর কে দায়িত্ব নেবে বা পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবেÑ তা এখনো অনিশ্চয়তায় ভরা। পরিস্থিতি শান্ত এবং নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনী দায়িত্বভার নেবে বলে এরই মধ্যে নেপালজুড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে।
পদত্যাগপত্রে প্রধানমন্ত্রী ওলি লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট, নেপালের সংবিধানের ৭৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সে কারণে সংবিধানের ৭৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আজ থেকেই আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’
এদিকে পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী ওলি দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ওলি বালুওয়াতারে তার সরকারি বাসভবন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসা ও দেশত্যাগের জন্য সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্য চেয়েছেন। ওলি চিকিৎসার অজুহাতে দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এ জন্য বেসরকারি বিমান সংস্থা হিমালয় এয়ারলাইনসকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে এনডিটিভিসহ ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ওলি হেলিকপ্টারে করে গোপন স্থানের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তাদের প্রকাশিত একটি ভিডিওতে সামরিক হেলিকপ্টারে কয়েকজনকে উঠতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়েছে, ওই হেলিকপ্টারে করেই ওলি অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন এবং সম্ভবত তিনি দুবাইয়ে যাবেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পর নেপালে এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার শুরু হয়েছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একসময় র্যাপার ছিলেন বালেন্দ্র শাহ। তিনি বেশি পরিচিত বালেন নামে। পরে রাজনীতিতে জড়ান। গত কয়েক দিন ধরে তরুণদের আন্দোলনের সময়ও তিনি সমর্থন জুগিয়েছেন। কেপি শর্মার পদত্যাগের পর আন্দোলনকারীদের অনেকে তাকে নেপালের নেতৃত্ব হাতে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্স-এ অনেকে ‘বালেন দাই, টেক দ্য লিড’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করছেন।
এদিকে এক ফেসবুকে পোস্টে বালেন্দ্র শাহ তরুণদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তরুণদের এখন শান্ত থাকতে হবে। আর যাতে প্রাণহানি না ঘটে, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করাটাও জরুরি। কারণ, এগুলো নেপালের জনগণের সম্পদ। শাহ উল্লেখ করেছেন, নেপালকে এখন তরুণরাই নেতৃত্ব দেবে।
এদিকে সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী প্রদীপ যাদব পদত্যাগ করেছেন। কৃষি ও পশুপালন মন্ত্রী রাম নাথ আধিকারী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তবে অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্রসাদ পাউডেলকে রাস্তায় ফেলে মারধর করেছেন বিক্ষোভকারীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে নেপালি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ভাইসেপতির বাসভবন থেকে মন্ত্রীদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট। মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনার পর এই পদক্ষেপ নিয়েছে সেনাবাহিনী।
গত সোমবার জেন-জিদের বিক্ষোভ একপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিলে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কিন্তু তারপরও দেশটির নতুন নতুন এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনও কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন সড়কে মিছিল ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও কারফিউ ভেঙেই বিক্ষোভ হয়েছে। আবার অনেক এলাকায় বিক্ষোভের মধ্যে গ্রেপ্তারেরও খবর পাওয়া গেছে।
কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাজধানী কাঠমান্ডু ও বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় জেন-জিরা। তারা নেতাদের বাসায় ইটপাটকেল ছোড়ে ও অগ্নিসংযোগ করে।
ললিতপুরে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী প্রত্যুষ সুব্বা গুরুংয়ের বাড়িতে আগুন লাগায় বিক্ষোভকারীরা। পাশাপাশি উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলের ভৈসেপাতির বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। গত সোমবার পদত্যাগ করা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাসভবনেও হামলা চালানো হয়। ভৈসেপাতিতে অবস্থিত নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বিশ্ব পাউডেলের বাসভবনেও হামলা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বুড়ানিলকণ্ঠায় অবস্থিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেস সভাপতি শেরবাহাদুর দেউবার বাসার সামনে পৌঁছালেও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের আটকায়। এ ছাড়া বিরোধী দল সিপিএন (মাওইস্ট সেন্টার) চেয়ারম্যান পুষ্পকমল দহলের খুমালতার বাসভবনেও ইটপাটকেল ছোড়ে বিক্ষোভকারীরা। স্থানীয় সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলায় মুখ্যমন্ত্রী, প্রাদেশিক মন্ত্রী ও অন্য নেতাদের বাসভবন লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে বিক্ষোভকারীরা
এ সময় বিক্ষোভকারীরা দেশেটির প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌডেল ও প্রধানমন্ত্রী ওলর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দাহাল প্রচ- ও শের বাহাদুর দেউবা এবং জ্বালানিমন্ত্রী দীপক খাডকার বাসভবনেও বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছে। নেপালি কংগ্রেসের সদর দপ্তরেও আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কাঠমান্ডুতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলেও বলপ্রয়োগ করেনি। লাউডস্পিকারে তারা বিক্ষোভকারীদের ঘরে ফিরে যেতে বলার সময় বিক্ষোভকারীদের দিক থেকে ‘সরকারে থাকা খুনিদের সাজা দাও, শিশুহত্যা বন্ধ করো’ স্লোগান শোনা গেছে।
বিক্ষোভের সময় পার্লামেন্ট ভবনের ক্ষতবিক্ষত প্রাচীরের বাইরে বিক্ষোভকারী নারায়ণ আচার্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক বার্তা সংস্থাকে বলেন, ‘আমরা এখানে বিক্ষোভ করতে এসেছি, কারণ আমাদের তরুণ ও বন্ধুদের হত্যা করা হচ্ছে। আমরা চাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং এই সরকার উৎখাত হোক। কেপি ওলিকে বিতাড়িত করা উচিত।’
আরেক বিক্ষোভকারী দুর্গানা দাহাল বলেন, ‘এত তরুণ ও শিক্ষার্থী, যাদের মাথা লক্ষ্য করে এই হিটলারসদৃশ কেপি ওলির সরকার গুলি করেছে, তাদের হত্যার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। যতক্ষণ এই সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, আমাদের মতো জনগণ ভুগতেই থাকবে’।
অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগন থাপাও বিক্ষোভে ১৯ মৃত্যুর নৈতিক দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে পদত্যাগ করতে বলেছেন।
এদিকে চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকালের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ এই অসুবিধার জন্য যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোটেশ্বরের কাছে ধোঁয়া দেখা যাওয়ার পর থেকেই এই সতর্কতা জারি করা হয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক হংসরাজ পান্ডে নিশ্চিত করেছেন, পরিস্থিতি গুরুতর হলেও বিমানবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ নয়।
নিবন্ধনহীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়ায় জেন-জি বিক্ষোভকারীরা গত সোমবার কাঠমান্ডুর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়। তারা দুর্নীতি এবং ব্যবস্থার সংকট নিয়েও প্রশ্ন তোলে। বিক্ষোভ পরে সহিংসতায় রূপ নিলে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীসহ ১৯ জন প্রাণ হারান। এরপরই আন্দোলন সরকারবিরোধী রূপ নেয়। বাধ্য হয়ে সরকার সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুললেও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ মূল দাবিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন দল, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ওলির মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও এই দাবিতে সংহতি জানান।
নেপালি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা প্রধানমন্ত্রী ওলি। এর আগে ২০১৫-১৬, ২০১৮-২১ ও পরে ২০২১ সালে আরও একবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন