যে শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ইতিহাসে কখনো প্রকাশ্যে প্যানেল দিতে পারেনি, সেই সংগঠন এবার প্রথমবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাজিমাত দেখিয়েছে। ডাকসুর ২৮ পদের মধ্যে ২৩ পদেই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে শিবিরের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। যার বিপরীতে ছাত্রদল একটি পদেও বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারেনি। শিবিরের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও ফলাফলে ভোটের সংখ্যায় ছিল ব্যপক তারতম্য। ছাত্রদল থেকে প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন শিবিরের প্রার্থীরা। ছাত্রদলের এ ভূমিধস পরাজয়ে হতবাক অনেকেই। কেন এই ভরাডুবি হলো, সেই হিসাব মিলাচ্ছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অনৈক্য আর প্রস্তুতির অভাবÑ নির্বাচনে ভরাডুবির মূল কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাবির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন ডাকসুর নির্বাচনের আলোচনা শুরু হয় তখন থেকেই ছাত্রশিবির ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অন্যদিকে ছাত্রদলের ডাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুত ছিল না। এমনকি কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নেতাও এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। এমনকি তারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টাও করেন। তবে শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় তারা সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ছাত্রদল নেতা জানান, ডাকসুতে ছাত্রদল যে প্যানেল দিয়েছিল তা অনেক নেতার পছন্দ হয়নি। আবার অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে মনোক্ষুণœ ছিলেন। এ ছাড়া সিনিয়র কয়েকজন নেতা ভোট করতে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে হাইকমান্ডের গ্রিন সিগনাল পাননি। ফলে এসব নেতা ছাত্রদলের প্যানেলের পক্ষে কাজ করেননি। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং ও অনৈক্যের কারণে নিজেদের নেতাকর্মীরাও ছাত্রদলকে ভোট দেননি। এর প্রমাণ মেলে ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটে। সব সেন্টারেই শিবিরের তিন প্রার্থী সমান ভোট পেলেও ছাত্রদলের ভোটে ছিল অনেক তারতম্য। এ ছাড়া ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণার পর মাত্র ২০ দিন সময় পাওয়ায় তারা ক্যাম্পাসের সব ভোটারের কাছে যেতেও পারেননি। এসব কারণেই মূলত ছাত্রদলের ভোটের মাঠে সুরও তুলতে পারেনি।
এসবের বাইরেও আরও কিছু কারণ দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক ছাত্রনেতারা। তারা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের মনোজগতে চিন্তার একটা পরিবর্তন এসেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় সংগঠনগুলোর আধিপত্যের বাইরে গিয়ে একটা বদল বা নতুন পরিবেশ চায়। ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিগত দিনে ক্যাম্পাসে আধিপত্যের রাজনীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামী দিনে বিএনপি সরকার গঠন করলেও ফের ছাত্রদল পুরোনো রূপে ফিরে আসবে এমন আশঙ্কা অনেকের। তারা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর ছাত্রদলের নেতারা অনেক জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলদারিতে জড়িয়েছেন। এসব বিবেচনায় তারা ছাত্রশিবিরকে ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারত ও ট্যাগের রাজনীতি নিয়ে একটা বিরূপ ধারণা ছিল। সে সবেরও প্রভাব পড়েছে ডাকসুর নির্বাচনে।
তারা আরও বলেন, ডাকসু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বর্তমান প্রজন্ম কী ধরনের নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। তাদের ভোটের ফল স্পষ্ট বার্তা দেয়, পুরোনো ধাঁচের স্বার্থকেন্দ্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দখলদারিত্বের রাজনীতি আর তারা মেনে নেবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ফল বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে সতর্কবার্তা।
তারা বলেন, আজকের তরুণরা স্বপ্ন দেখে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সৎ নেতৃত্বের। তারা চায় একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যেখানে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজি থাকবে না। আর যাদের মধ্যে এসব অসুস্থ রাজনীতি চর্চা হবে বর্তমান প্রজন্ম ঘৃণাভরে সেই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে।
তবে নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল। দলটির পরাজিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ভোটের দিনই নির্বাচন বয়কট করেছেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমার দিনটা শুরু হয় মিডিয়ার অপপ্রচার দিয়ে। দুপুর থেকেই আমি ভোটে বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক সমস্যা খুঁজে পেয়েছি, সারাটা দিন সেসব নিয়ে কথা বলেছি। এসব অভিযোগের একটা সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে আসবে বলে এখনো আশা রাখি।’
সার্বিক বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, সরকারি দলের বিপরীতে সব সময় একটি মনোভাব তৈরি হয়। সেই মনোভাব তৈরি হয়েছিল ছাত্রদের মধ্যে। কারণ বিএনপি আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারে এটা এমন ধারণা সবার মধ্যে। যদি বিএনপি ক্ষমতায় চায় তাহলে ছাত্রদল হয়তোবা ছাত্রলীগের মতো আগ্রাসী ভূমিকায় আসতে পারে এ শঙ্কা ছিল অনেকের মধ্যে। তারা ছাত্রলীগের সমান বিবেচনা নিয়েছিল ছাত্রদলকে। এই ভয়ে ভীত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলকে ভোট দেয়নি এটা আমার ধারণা।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের পর বেশির ভাগ মানুষ ক্ষমতার একটা পরিবর্তন চায়। মানুষ ভালো আচরণ চায়। সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাত্রশিবির ভালো আচরণ করে, তারা চাঁদাবাজি-দখলবাজি লুটপাটের মধ্যে নেই। এটাও ভোটে বড় প্রভাব রাখতে পারে।
নির্বাচনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি বড় প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে যারা থাকুক না কেন এর সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব, পরিকল্পনা বা নেপথ্যে শিবির ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিবিরকে রায় দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন যেভাবে আধিপত্য দেখিয়েছে সেটার বিরুদ্ধে শিবিরকে ভোট দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটা সুস্পষ্ট প্রতিবাদ।
শিবিরকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে ডা. মুশতাক আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন থেকে হল দখল, গেস্টরুমের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার। তারা একটা ভালো বিকল্প খুঁজছে। নির্বাচনে যত প্যানেল দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে শিবিরকে বেছে নেওয়ার কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হল দখলের ইতিহাস নেই। যদিও রাজশাহী, চট্টগ্রামে তারা হল দখল করে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ নির্বাচনে অনেক কারচুপির অভিযোগ এসেছে। ভোটের ফলাফল নিয়ে আমরা সন্দিহান। যে অভিযোগগুলো এসেছে, তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় তার প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়তে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন, পতিত সরকারের দোসরদের কারণে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে। এ নির্বাচন বিএনপিকে একটি সতর্ক সংকেত দিয়েছে।
অন্যদিকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ছাত্রদল গত ১৬ বছরে হাসিনা সরকারের আমলে কিছুই করতে পারেনি। তা ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে তরুণরা চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব দেখতে চান না। এ জন্য ছাত্রদল ডাকসুতে ডুবে গেছে।
আর ডাকসুর সাবেক নেতা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিএনপির মধ্যে লুটপাট-দুর্নীতি নাই। ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে অনেক কিছু প্রশ্ন রয়েছে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে একটি চক্র লেগেছিল। অনেক শিক্ষার্থীরা না বুঝেই ছাত্রদলের সমালোচনা করেছেন। তা ছাড়া মিডিয়ার ট্রায়ালের ক্ষতি তো হয়েছেই। অনেক দিন পর নির্বাচন হয়েছে বিধায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি তো ছিলই।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন