রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ১১:১৬ পিএম

বনের রাজা যুবলীগ নেতা খোরশেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ১১:১৬ পিএম

বনের রাজা যুবলীগ নেতা খোরশেদ

  • বনের ৩০ একর জমি দখল খোরশেদের। হয়েছেন কোটি টাকার মালিক
  • ৩৫ বছরে ফুলবাড়িয়ার সন্তোসপুর বিটের বনের কয়েক লাখ গাছ নিধন
  • বনের গাছ নিধন ও বিক্রির অভিযোগে ৪০ মামলা হলেও অধরা
  • বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে বনের জমি দখল ও চাঁদাবাজি
  • নিজের জায়গায় বাড়ি করতেও খোরশেদকে দিতে হয় চাঁদা

সালটা ১৯৮৮ কিংবা ১৯৮৯। বেপরোয়া জীবনযাপন, কাজ না করা, বিভিন্ন অপকর্মের নালিশের কারণে যুবক খোরশেদ আলমকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা। এরপর শুরু হয় খোরশেদের ডাকাতির জীবন। একইসঙ্গে শুরু করেন বনের গাছ কেটে বিক্রি। এভাবে কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর ডাকাতি ছেড়ে বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে বনের রাজা হয়ে ওঠেন খোরশেদ। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের ধারাবাহিকতায় তিনি বনে গেছেন বনের রাজা।

খোরশেদ আলম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের বাবুলের বাজার এলাকার জালাল উদ্দিনের ছেলে। তারা চার ভাই। চাচা লালু মেম্বার রাঙামাটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন খোরশেদ। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। 

সরেজমিনে জানা যায়, সন্তোসপুর বিট বা আশপাশের এলাকায় নিজের জমিতে কেউ বাড়িঘর নির্মাণ করতে চাইলে খোরশেদ আলমকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এমনকি একটি কাঁচা টয়লেট তৈরি করলেও খোরশেদকে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বাড়িঘর নির্মাণ করতে চাঁদা না দিলে বন বিভাগের লোকজন দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। বাড়িঘর ভাঙতে স্থানীয়রা বাধা দিলে তাদের মামলা দিয়ে করা হয় হয়রানি। এসব চাঁদার টাকা থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ভাগ পান বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয় সূত্র জানায়, খোরশেদ আলমের বয়স যখন ১৮ কি ২০, বেপরোয়া জীবনযাপন ও বিভিন্ন কুকর্মের নালিশ আসায় বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখন থেকে বনের গাছ কাটা ও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েন খোরশেদ আলম। বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৯০ সালের পর রাতের আঁধারে দৈনিক বনের গাছ কেটে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা শুরু করেন। ১৯৯০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর ধরে চলতে থাকে বনের গাছ নিধন। এভাবে বনের কত লাখ গাছ কেটে বিক্রি করেছে তার হিসাব নেই।

ট্রাকসহ বনের গাছ বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়ায় খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে অন্তত ৪০টি মামলা হয়। পরে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর কয়েক বছর পরে ছিদ্দিখালী এলাকায় স’মিল ভাড়া নিয়ে প্রকাশ্যে বনের গাছ কেটে বিক্রি করা শুরু করেন। ২০১৮ সালে বাবুলের বাজার এলাকায় খোরশেদ নিজেই বনের জমিতে স’মিল বসিয়ে বনের গাছ কেটে বিক্রি করা শুরু করেন। বিভাগের কর্মকর্তাদের হাত করে এখনো চলছে সেই স’মিল। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, নামে-বেনামে খোরশেদ আলমের সম্পদেরও কমতি নেই। রাঙ্গামাটিয়া মৌজায়, বাবুলের বাজার এলাকায় ৮৮৮২ দাগে ১৭ শতাংশ, ৭১১৯ দাগে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, ৯০১৯ দাগে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ  ৭১১৯ দাগে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমি রয়েছে। এসব জমির বাজার মূল্য অন্তত ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়াও বাবুলের বাজার, সাগরদিঘী বাজারে রয়েছে অন্তত ১৫টি দোকান। যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। শ্বশুরের নামে সাগরদীঘিতে ৫ শতাংশ জায়গায় একটি দোকান আছে, যার মূল্য আনুমানিক সোয়া কোটি টাকা। এসব সম্পদ বন বিভাগের গাছ চুরি ও চাঁদাবাজি করে অবৈধভাবে অর্জন করে বনের হয়েছেন রাজা খোরশেদ। পাশাপাশি হাতীলেইট বাজারের মাঝখানে ২৬ শতাংশ, বাবুলের বাজারে ২০ শতাংশ, হাতীলেইট গয়লা স্কুলের কাছে ৪ একর জমির মাছের খামার, বাবুলের বাজারের পশ্চিম পাশে বনের ৫ একর জমি, যা অবৈধ টাকা দিয়ে নিজের নামে করে নেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, খোরশেদ আলম বন বিভাগের লোকজনের সহায়তায় চাঁদবাজি, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, অবৈধ স’মিল দিয়ে বনের সরকারি গাছ রাতের আঁধারে চুরি করে বিক্রি করে কোটি কোটি অবৈধ টাকার মালিক হয়েছেন। এ ছাড়াও গত ৩৫ বছরে অন্তত বনের ৩০ একর বনের জায়গা দখল করেছেন তিনি। প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকায় লোকজন ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। বন বিভাগের গাছ কেটে বিক্রি করায় ৪০টি মামলা হলেও দিব্যি বন ধ্বংস ও চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা আলাল উদ্দিন বলেন, নিজের জমিতে কেউ বাড়িঘর নির্মাণ করতে চাইলে খোরশেদ আলমকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কাঁচা টয়লেট, গোয়াল ঘর তৈরি করলেও খোরশেদকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন সাধারণ মানুষকে। বাড়িঘর নির্মাণ করতে চাঁদা না দিলে বন বিভাগের লোকজন দিয়ে নির্মাণাধীন বাড়ি ভেঙে দেয়। বাড়িঘর ভাঙতে স্থানীয়রা বাধা দিলে তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এসব চাঁদার টাকা থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ভাগ পান বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমি এক বছর আগে একটি পাকা ঘর তুলতে চাইলে খোরশেদ চাঁদা দাবি করে। পরে খোরশেদকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর তুলার কাজ শুরু করি। পরে আবারও সে এক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মামলা হবে বলে হুমকি দেয়। টাকা না দেওয়ায় বন বিভাগের কর্মকর্তারা আমার নির্মাণাধীন ঘর ভেঙে দিতে চায়। পরে স্থানীয়রা বাধা দিলে বন বিভাগের লোকেরা ৯ জনকে আসামি করে তিনটি মামলা করে। এখনো সেই মামলা চালিয়ে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগের সময় বনের গাছ বিক্রি করে ও চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

স্থানীয় গয়লাপাড়া এলাকার আব্দুর রহিম তরফদার বলেন, আমার নিজের রেকর্ড জমিতে ঘর তুলতে চাইলে খোরশেদ কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিয়ে ঘর তুলতে চাইলে বন কর্মকর্তা ভেকু নিয়ে আমার ঘর ভেঙে দিতে আসে। স্থানীয়রা বাধা দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়। মামলায় একবার হাজিরা দিয়েছি। 

স্থানীয় গোলাপ মিয়া নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমার নিজের জমিতে ঘর তুলতে চাইলে খোরশেদ টাকা দাবি করে এবং মামলার হুমকি দেয়। আমি চাঁদা না দিয়ে পাকা ঘর তুলা শুরু করলে বন কর্মকর্তারা আমার ঘর ভাঙতে আসে। পরে স্থানীয়রা বাধা দিলে ৬ জনের নামে ৯টি মামলা দেয় বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

যুবলীগ নেতা খোরশেদ আলমের মোবাইল নাম্বারে ফোন দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘আমি গাড়িতে আছি, পরে কথা হবে বলে লাইন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সন্তোসপুর বিট কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, বন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সঙ্গে খোরশেদের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি আমাদের বিষয়ে বলে থাকে, তাহলে আপনাকে ভুল বুজিয়েছে। আমি এখানে যোগদান করেছি আনুমানিক এক বছর হবে। আমি এখানে আসার পর বনের গাছ কাটার জন্য খোরশেদের নামে দুটি মামলা দিয়েছি।

বনের জমিতে খোরশেদের স’মিল কীভাবে এখনো চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বনের জমিতে স’মিলটি উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া, আমি আসার আগে সে কি করেছে। সেটি আমার দেখার বিষয় না। তবে, তার সঙ্গে বন বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই।’

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল করিম বলেন, ৩৫ বছর ধরে বনের জমি দখল, চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ যদি অভিযোগ করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বনের জমি থেকে যেন স’মিলটি উচ্ছেদ করা হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বনের জমি ও গাছ নিধনের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ময়মনসিংহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, যে ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাইছেন, তার সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তবে, কেউ যদি কোনো অভিযোগ করে, তাহলে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!