ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বললেন প্রধান উপদেষ্টা

ফেব্রুয়ারিতেই মহোৎসবের জাতীয় নির্বাচন

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১০:৩৯ পিএম

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের পথে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটি হবে ‘জাতির নবজন্মের মহোৎসব’। গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শুরুতে যখন কমিশনের ধারণা এলো, আমি নিশ্চিত ছিলাম না, এটা টিকবে কি না। কিন্তু আজ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর আপনাদের আলোচনা ও সিদ্ধান্তে আমি অভিভূত হয়েছি।’

কমিশনের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোও অনুসরণ করবে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে না, সারা দুনিয়া লক্ষ করবে আমরা কীভাবে সমস্যার সমাধান করলাম।’ প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, ‘জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প পথ নেই। যে পথে আমরা শুরু করেছি, সেই পথ থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সমতায় আমাদের আসতেই হবে। এটাই ছাত্র-জনতার দেওয়া সুযোগ, যেখান থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।’ আগামী নির্বাচনের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। সেটি হবে মহোৎসবের নির্বাচন, যদি আমরা ঐকমত্যের মাধ্যমে ফয়সালা করতে পারি। এই নির্বাচন শুধু নির্বাচন নয়, এটি হবে জাতির নবজন্ম।’

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘জাতির সত্যিকার নবজন্ম হবে। এটা শুধু নির্বাচন না, এটা নবজন্ম। এই যে এত ত্যাগ, এত রক্তÑ এগুলো সার্থক হবে যদি আমরা এই নবজন্মটা লাভ করতে পারি।’ বিভাজন বা দ্বিমতের কোনো স্থান নেই বলে সতর্ক করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা অনেক কথা বলতে পারি, কিন্তু দ্বিমত রেখে সমাপ্ত করতে পারব না। যখন ঐকমত্যে পৌঁছাব, তখনই নির্বাচন সার্থক হবে।’

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমাদের হাতে এখন আলাদিনের প্রদীপের মতো সুযোগ এসেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সেই শক্তি এনে দিয়েছে। আমরা চাইলে ছোটখাটো বিষয় চাইতে পারি, আবার চাইলে পুরো জাতিকে নতুনভাবে গড়তে পারি। এই সুযোগ একবারই এসেছে, আর আসবে না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এত বড় কাজ আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না। তাই ধৈর্য ধরে আমাদের এগোতে হবে। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমাদের কাজ হলো, কোনো দ্বন্দ্ব ছাড়াই মহোৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি, এখন শুধু সাইনবোর্ড বসানো বাকি। পথ ঠিক আছে, গন্তব্য পরিষ্কার। এই নির্বাচন হবে উৎসবের নির্বাচন, দেশের শান্তি ও নতুন যাত্রার সূচনা।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো সব পথঘাট বন্ধ করা, যাতে কোনো স্বৈরাচার আর ফিরে আসতে না পারে। এ জন্য সবাইকে একমত হতে হবে।’ কমিশনের কাজকে অভূতপূর্ব অর্জন বলে অভিহিত করেন প্রধান উপদেষ্টা। কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের পরিশ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছেন। এখন শুধু এটিকে নিখুঁতভাবে সমাপ্ত করা দরকার। এর মধ্য দিয়েই নতুন জাতির জন্ম ঘটবে।’

রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবার আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঐকমত্যের এই পথেই আমরা এগোব, নির্বাচন সফল করব এবং জাতি হিসেবে মহা-উৎসবের যাত্রা শুরু করব।’

এ সময় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার।

বৈঠকে অনড় অবস্থান থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সংস্কার বা বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের জন্য বিএনপি ইতিমধ্যে দুজন প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত। তবে কিছু কারেকশন ও পর্যবেক্ষণ আছে, সেগুলো জানানো হবে।’ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিতে পারেন বলে সালাহউদ্দিন আহমদ প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি ছোট ছোট বৈঠকের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে সনদ বাস্তবায়নের পথ আরও সুসংহত করার আহ্বান জানান তিনি। জুলাই সনদকে একটি ঐতিহাসিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল আখ্যা দিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এটি এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।’

নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘এটি কোনোভাবেই শর্তাধীন নয়। সংস্কার চলবে, বিচারপ্রক্রিয়া চলবে, তবে নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই হতে হবে।’ ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির প্রধান প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তা শুধু জাতীয় নিরাপত্তাই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদ এবং জাতির দৃঢ়সংকল্প হলোÑ একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। ফেব্রুয়ারির এই নির্বাচন বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে।’

এদিকে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে অনড় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী। দলটি মনে করছে, সংবিধান আদেশ ২০২৫ জারি করলে ভবিষ্যতে এই সনদ আইনি চ্যালেঞ্জে পড়বে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ‘সংবিধান আদেশে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এতে করে পরবর্তীতে কেউ এটি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকবে না।। কারণ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭১ অনুচ্ছেদে জনগণের অভিপ্রায়ের যে কথা বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী সংবিধান আদেশ হলে এটি শক্তিশালী হবে।’ হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিলে আগামীতে এর ভিত্তিতেই ভোট হতে হবে। এতে নির্বাচন উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদে ৮৪টি বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাই এটি বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই। আলোচনারও কিছু নেই। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, সনদ সই হলেই রাষ্ট্রীয় দলিল হিসেবে স্বীকৃত হবে। গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রায় এর আইনি ভিত্তির বিকল্প নেই। যাতে করে পরবর্তীতে কেউ চ্যালেঞ্জ করে এটি রহিত করার সুযোগ না পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অতীতে এ ধরনের নজির রয়েছে। এমনকি সাংবিধানিক সংশোধনীও রহিত করা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীও বাতিল করা হয়েছে। তাই জুলাই সনদকে সংবিধান আদেশে আইনি ভিত্তি দেওয়ার কথা বলেছি।’ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আরও জানান, আমরা সাংবিধানিক নয়, সংবিধান আদেশ চাই। কারণ সাংবিধানিক আদেশও অনেক সময় চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকে।

সংবিধান আদেশ হলে এটি শক্তিশালী হবে। আর গণভোটের মাধ্যমে হলে আরও মজবুত হবে। আমরা সে প্রস্তাব দিয়েছি।’ সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে সমাধানে আসতে হবে জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, গণপরিষদই হতে পারে সমাধান। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘শেষপ্রান্তে এসে আমরা আশা হারাতে চাই না। সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে সমাধানে আসতে হবে। এত দিনের আলোচনায় জুলাই সনদ যেন আইনি ভিত্তি পায় সেটা আমরা চাই। ৮৪ পয়েন্টের মধ্যে ৪৩টি সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত, গণপরিষদের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’