ঢাকা সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ডেঙ্গুতে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু

এক দিনেই ১২ জনের প্রাণহানি

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম

যত দিন যাচ্ছে, ডেঙ্গুর রুদ্রমূর্তি যেন ততই প্রকট হচ্ছে। গত এক দিনে বছরের সর্বোচ্চ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু দেখল দেশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৭৪০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ছয়জন। এক লাফে মৃত্যুসংখ্যা ১২ জনে পৌঁছে যাওয়ায় ডেঙ্গু আতঙ্কে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সামান্য জ¦রকেও অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। 

গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু-বিষয়ক নিয়মিত এসব তথ্য জানানো হয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৬৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৭ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪৭ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১২২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১১৫ জন, খুলনা বিভাগে ৫২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২২ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৮ জন, রংপুর বিভাগে তিনজন ও সিলেট বিভাগে ৯ জন রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে ৬৮৩ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৬৩১।

২৪ ঘণ্টায় যে ১২ জন মারা গেছে, তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে পাঁচজন, চট্টগ্রাম বিভাগে একজন, ঢাকা উত্তর সিটিতে তিনজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে দুজন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে একজন রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ৪১ হাজার ৮৩১ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১৭৯ জনের।

চলতি বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাতে থাকে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ। এডিসের লার্ভা ধ্বংসে দুই সিটির ব্যর্থতা, জনপ্রতিনিধি না থাকা, অতিবৃষ্টি-অতিগরমের মতো বৈরী আবহাওয়ার কারণে জানুয়ারির শুরু থেকেই বাড়তে থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এর তীব্রতাও। জুন-জুলাইয়ে যেমন-তেমন, সেপ্টেম্বরে ছাড়িয়েছে আগের সব রেকর্ড। রাজধানীসহ দেশের সব কয়টি হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি যে বাড়াতে হয়েছে ওয়ার্ডও। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড), কুর্মিটোলার মতো হাসপাতালগুলোতে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা। এ অবস্থা চলতে থাকলে অক্টোবরে পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত চিকিৎসকেরা। 

গতকাল রোববার রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছে তিন শতাধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি রয়েছে শিশুরাও। চাপ বাড়ায় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় আরেকটি ওয়ার্ড বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মেজবাউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রোগী ভর্তি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। গত আগস্টে আমাদের এখানে হাজারের মতো রোগী ছিল, কিন্তু সেটা চলতি মাসের প্রথম চার দিনেই ৫০০-এর বেশি হয়ে গেছে। রোগী আরও বাড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে তিনটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় তলায় নারী ওয়ার্ডে ১২০ জন ও দশম তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে ১৪০ জন রোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর শিশু ওয়ার্ডে ১২০ জনকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১১ তলাও প্রস্তুত করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সেখানেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ড বাড়ছে। তাই চিকিৎসকের সংকটও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের এখানে কিছু চিকিৎসক পদায়ন করা হয়েছে। রেশনিং করে ডাক্তার ও নার্সদের দ্বারা চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগে যাত্রাবাড়ী, কাজলা, ধলপুর ও এর আশপাশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা  থেকে বেশি রোগী আসত। কিন্তু এখন সব এলাকা থেকেই রোগী আসছে। ঢাকার বাইরে থেকেও ৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তবে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’

একই অবস্থা রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও (মিটফোর্ড)। রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে এখানে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন জুয়েল মিয়া। মশার যন্ত্রণায় বাড়িতে দিনের বেলায় মশারি টানিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে নামকাওয়াস্তে মশা নিধন কার্যক্রম করা হয়। কিন্তু ফগার মেশিনে ওষুধ দেয়, নাকি খালি ধোঁয়া দেয় কে জানে! মশা তো মরে না। প্রথমে ছোট মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পরে ছেলেটা। এখন আমি। বাড়িতে থেকেই তারা সুস্থ হলেও আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় স্ত্রী পরশু রাতে নিয়ে আসছে হাসপাতালে। এখন আগের চাইতে একটু ভালো আছি। 

তবে একটি সিটও ফাঁকা নেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে। বরং একেকটা সিটে দুই থেকে তিনজন করেও রোগী ভর্তি রয়েছে। এ অবস্থায় যদি রোগী আরও বাড়ে, তাহলে ওয়ার্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের এখানে শুধু ডেঙ্গু রোগী নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জটিল রোগী আসে প্রতিদিন। সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। আমরা সেবা দেওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। রোগী যদি আরও বাড়ে, তাহলে ওয়ার্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। এমন পরিস্থিতিতে আর নির্দিষ্ট সময় নয়, বরং সারা বছর এডিস মশা নিধনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জন এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।