ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য। শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রত্যাশায় দেশগুলো ফিলিস্তিনকে এই স্বীকৃতি দেয়। গতকাল রোববার এ তিন দেশ পর্যায়ক্রমে স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়। তিন দেশের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের গতি পুনরুজ্জীবিত করার অংশ হিসেবেই এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এই রাষ্ট্রের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে শিল্পোন্নত (জি-সেভেন) সাত দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও কানাডা প্রথম ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল।
প্রথমে কানাডা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক বিবৃতিতে বলেন, আজ (গতকাল) থেকে কানাডা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয় রাষ্ট্রের একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসরায়েলের বর্তমান সরকার পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে। পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে দখলদারি বিস্তার করছে, আর গাজায় দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হামলায় লাখো বেসামরিক নিহত, বাস্তুচ্যুত ও মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ভুগছে।’
অস্ট্রেলিয়ার সরকারও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একইভাবে যুক্তরাজ্যও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এরপর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এক ভিডিও বার্তায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহতা বাড়তে থাকার মুখে আমরা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান ও শান্তির সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখতে কাজ করছি। এর অর্থ একটি টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পাশে একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরায়েলÑ যার কোনোটি এই মুহূর্তে আমরা দেখছি না।’ এরপর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির সময় এখন এসেছে। তাই আজকে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান ও শান্তির আশা পুনরুজ্জীবিত করতে আমি এই মহান দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্পষ্টত ঘোষণা করছি যে, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।’
এর আগে গত জুলাই মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হয় এবং টেকসই শান্তিচুক্তি ও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথে অঙ্গীকার না করে, তবে যুক্তরাজ্য তাদের অবস্থান বদলাবে।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের দেশ পর্তুগাল ও ফ্রান্সও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ইউরোপের আরও তিনটি দেশ স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে গত বছরই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে ইসরায়েলি সরকার, জিম্মিদের পরিবার ও কিছু কনজারভেটিভ নেতা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, এমন পদক্ষেপ ‘সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করার’ সমান। তবে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তির আশা টিকিয়ে রাখতে নৈতিক দায়িত্ব থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সরকারি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তারা বলছে, গাজায় অনাহার ও সহিংসতার চিত্র ‘সহ্য করা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের সর্বশেষ স্থল অভিযানকে এক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ‘মহাপ্রলয়সদৃশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। দখলদার বাহিনীর অভিযানে লাখ লাখ মানুষ গাজা সিটি থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে জাতিসংঘের এক তদন্ত কমিশন উপসংহার টানে যে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে। ইসরায়েল এই প্রতিবেদনকে ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা আরও বলেন, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের ক্রমাগত সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ ও এটাই তাদের এই সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস চলতি মাসের শুরুতে স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানান। দুই নেতা একমত হন যে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন শাসনব্যবস্থায় হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। স্টারমার আগেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সময়সীমা হিসেবে ঠিক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি ইসরায়েল গাজার পরিস্থিতির অবসান, যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তির পথে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়, তবে যুক্তরাজ্য এই পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, আমি সব সময়ই বলেছি, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে তখনই, যখন তা শান্তি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় অবদান রাখবে। এখন যখন সেই সমাধান হুমকির মুখে, তখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
এদিকে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাওয়া যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা। তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ নিউ ইয়র্কের এলিস স্টেফ্যানিক ও টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ আছেন। গত শনিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে বলেছেন যে তারা যেন ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেন। চিঠিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকেও পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।