বাংলাদেশের শ্রমশক্তির নতুন বাজার তৈরি ও কৃষি প্রযুক্তি সহায়তায় জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতিসংঘে সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নেন আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বাজরাম বেগাজ। এ সময় তিনি দেশটির ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী নিয়োগে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট বেগাজ বলেন, ‘আমাদের দেশে শ্রমিক প্রয়োজন। আলবেনিয়ার বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ তার গতিশীল ও তরুণ কর্মশক্তি দিয়ে আলবেনিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে প্রস্তুত।’
তবে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে আলবেনিয়ার রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘কারণ বর্তমানে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসার জন্য আবেদন করতে ভারতের নয়াদিল্লি যেতে হয়।’ প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট বেগাজ জানান, আলবেনিয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-ভিসা চালুর বিষয়টি বিবেচনা করছে। তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারে উচ্চপর্যায়ের সরকারি সফরসহ প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।’
বৈঠকে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশ চিকিৎসক ও নার্স থেকে শুরু করে কারখানা ও কৃষিশ্রমিক পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের জনশক্তি সরবরাহে সক্ষম। তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজ করতে সমঝোতা স্মারক (গড়ট) স্বাক্ষরের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রেসিডেন্ট বেগাজ আরও জানান, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ভর্তি স্কিমের আওতায় আলবেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
এর আগে দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রথমেই নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফের সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। অধিবেশনের সাইডলাইনে আয়োজিত এ বৈঠকে বাংলাদেশের গ্রামে হিমাগার স্থাপনে নেদারল্যান্ডস সরকারের সাহায্য চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। এ সময় ডাচ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস কৃষি প্রযুক্তিতে বিশ্বনেতা। আমাদের প্রয়োজন আপনার দেশের আধুনিক প্রযুক্তি, যাতে আমরা আমাদের ফল ও শাকসবজি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারি। এ ছাড়া, আপনারা চাইলে আমাদের কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার জন্য গবেষক ও বিজ্ঞানী পাঠাতে পারেন।’
অধ্যাপক ইউনূস নেদারল্যান্ডসের পানি ব্যবস্থাপনা, নদী ব্যবস্থাপনা ও সামুদ্রিক প্রযুক্তিতে নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমরা চাই নেদারল্যান্ডস আমাদের জলবায়ু ও পানি ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র গবেষণা এবং বাংলাদেশের নদীগুলোকে নৌগমনযোগ্য রাখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।’
ডাচ প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার উত্থাপিত বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং জবাবে বলেন, ‘উত্থাপিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করব। এ ছাড়া, বস্ত্র খাতেও সহযোগিতার সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে আগ্রহী।’
বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম, মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতির বিষয়েও আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করেন।
এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল উচ্চপর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, যার শিরোনাম ছিল ‘সবার জন্য, সর্বত্র মানবাধিকার আমাদের অভিন্ন মানবতার মূল ভিত্তি।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ওএইচসিএইচআর (ঙঐঈঐজ) বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির শেষটিতে বৃহস্পতিবার রাতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে আয়োজিত শ্রম অধিকার ও সংস্কার নিয়ে নৈশভোজ আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন। উচ্চ পর্যায়ের এই নৈশভোজে কূটনীতিক, জাতিসংঘ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা একত্রিত হয়ে দেশের শ্রম আইন, শ্রমিক অধিকার ও চলমান সংস্কার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।
এ সময় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বৃহৎ পরিসরে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে শ্রম সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’ তিনি আশ্বাস দেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুতফে সিদ্দিকী। এতে আইএলও মহাপরিচালকসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা মন্তব্য তুলে ধরেন। অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক অবস্থানে শ্রম সংস্কারের বিস্তৃত প্রভাব নিয়ে মত দেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন