ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি বিশ্বনেতাদের পূর্ণ সমর্থন

শাওন সোলায়মান, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫, ১১:১৩ পিএম

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানাতে গত শুক্রবার নিউইয়র্কে তার হোটেল স্যুটে একত্র হন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী নেতারা। তারা বাংলাদেশকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এদিকে জাতিসংঘে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিএনপি ও জামায়াত।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নিজামি গঞ্জাভি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (এনজিআইসি) সহসভাপতি ভাইরা ভিকে-ফ্রেইবারগার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এনজিআইসির নামকরণ করা হয়েছে খ্যাতনামা একাদশ শতকের পারস্য কবি নিজামি গঞ্জাভির নামে।

উচ্চপর্যায়ের এই দলে ছিলেন স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরুত পাহোর, সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরিস তাদিচ, লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এগিলস লেভিটস, ইউরোপীয় কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল, গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ, বুলগেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোসেন প্লেভনেলিভ ও পেতার স্তোইয়ানোভ, ক্রোয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো যোসিপোভিচ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্লাদেন ইভানিচ এবং মরিশাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট আমিনা গুরিব-ফাকিম।

বৈঠকে কমনওয়েলথের সাবেক মহাসচিব, জর্জিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চারজন সাবেক সভাপতি, একাধিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের সাবেক সহসভাপতি ও এনজিআইসির সহসভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন, মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্ব, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার সারা জীবনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তারা বলেন, ‘আমরা আপনাকে ও বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন জানাতে এসেছি। আমরা আপনার পাশে আছি।’ অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছরের দুর্নীতি, শোষণ ও অপশাসনের কারণে দেশটি এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।’

বিভিন্ন নেতা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তাদের একজন বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। যেকোনো পরামর্শ বা সহায়তা প্রয়োজন হলে জানাবেন।’ সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা সফরকারী কেরি কেনেডি বাংলাদেশের মানবাধিকার অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, ‘মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আপনাদের অর্জন অসাধারণ।’

জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির নির্বাহী পরিচালক মেলান ভারভিয়ার জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান শিগগিরই বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করবে। এনজিআইসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলদিন বলেন, ‘আপনাদের প্রয়োজন হলে আমরা আছি।’

সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস এভাবে অপ্রত্যাশিত সমর্থন পেয়ে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমাদের সমর্থনে একসঙ্গে আপনাদের দাঁড়ানো সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমি একেবারেই মুগ্ধ।’ তিনি বাংলাদেশের অবস্থা তুলনা করেন একটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে ফেরার সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘দেশটি গত ১৬ বছর ধরে একটি ভূমিকম্পের মধ্যে ছিল। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৯।’

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘সীমিত সম্পদের কারণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ তাৎক্ষণিক পরিবর্তন দেখতে চায়, কিন্তু আমাদের অবশ্যই তরুণদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে, তারা একটি নতুন বাংলাদেশ খুঁজছে।’ অধ্যাপক ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সমর্থন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। আপনাদের পরামর্শ, সহযোগিতা ও নৈতিক শক্তি আমাদের জন্য অমূল্য।’ সভায় এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের ভূয়সী প্রশংসায় বিএনপি ও জামায়াত: এদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া ভাষণকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার, আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভাষণটিকে দৃঢ় ও প্রাসঙ্গিক হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এই ভাষণ শক্তিশালী ছিল। প্রধান উপদেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ে বারবার নির্বাচনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। আমরা নিশ্চিত যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে সরকারের সংস্কার এজেন্ডা এবং জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি যথাযথভাবে বলেছেন, আমাদের সরকার যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে, তার প্রতিফলন ভাষণে প্রকাশ পেয়েছে।

ফখরুল আরও বলেন, অধ্যাপক ইউনূস বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে তার সরকার কাজ শুরু করেছে, দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি পূরণে উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক নেতাদের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তিনি বলেন, এটি জাতীয় ঐক্যের প্রদর্শন এবং এ জন্য আমরা আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা জানিয়েছি।

এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে প্রশংসনীয় বলে অভিহিত করে বলেন, সর্বপ্রথম কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্তর্জাতিক মহলে অংশগ্রহণ করেছেন, এটি সত্যিই ব্যতিক্রম ও প্রশংসনীয় ঘটনা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভাষণটিকে যুগান্তকারী বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে ন্যায়বিচার, সংস্কার ও আন্তর্জাতিক একাত্মতার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা শক্তিশালী করতে এবং উন্নয়নশীল দেশের কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রূপান্তরের কথা তুলে ধরে নিজ ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যুবসমাজ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জুলাই ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সংস্কারের পথে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক ও শাসনব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে বলেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি গ্রহণ, মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা এবং অতীতের নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

প্রবাসী কর্মীদের অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা দেশের জন্য রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এ অবদান দেশে ও কর্মস্থলে সমানভাবে মূল্যবান। তিনি রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানান। ইসরায়েলের গণহত্যার কঠোর নিন্দা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা গাজায় সহিংসতা বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানান। তিনি দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি বাংলাদেশের অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

জাতিসংঘের অধিবেশনে শুক্রবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জামায়াত নেতা ড. নকীবুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টিন (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন এবং এনসিপির প্রথম সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা উপস্থিত ছিলেন।