গাজা শাসনব্যবস্থার খসড়া পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে গত সপ্তাহের শুরুর দিকে। সেই পরিকল্পনায় সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নাম উঠে এসেছে। ব্লেয়ারই ব্রিটেনকে ইরাকযুদ্ধে নামিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর থেকে তিনি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ব্যবসা করছেন আর প্রভাব বিস্তার করছেন। এবার তাকে ফিলিস্তিন ভূখ- গাজায় এক অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে।
গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথরিটি বা জিআইটিএ নামে যে কাঠামোর খসড়া তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে ওপরে থাকবেন কোটিপতি ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা। আর নিচে থাকবেন খুঁটিয়ে যাচাই-বাছাই করা ‘নিরপেক্ষ’ ফিলিস্তিনি প্রশাসকেরা।
এই প্রশাসন ইসরায়েল, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। ইসরায়েলি সরকারের সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির দৈনিক হারেৎজ বলছে, পরিকল্পনাটি হোয়াইট হাউসেরও সমর্থন পেয়েছে। খসড়া অনুসারে, জিআইটিএর দায়িত্বে থাকবে একটি আন্তর্জাতিক বোর্ড। এই বোর্ডের হাতে থাকবে ‘অন্তর্বর্তী সময়ে গাজা শাসনের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও আইনি ক্ষমতা।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারজনের নাম সম্ভাব্য বোর্ড সদস্য হিসেবে উল্লেখ আছে। এদের কেউই ফিলিস্তিনি নন। এর মধ্যে একজন হলেন সিগ্রিড কাগ, যিনি জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার বিশেষ সমন্বয়ক। অন্যদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশিষ্ট নির্বাহী ও আর্থিক বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে। এরা হলেনÑ মার্ক রোয়ান, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় প্রাইভেট ইকুইটি প্রতিষ্ঠানের মালিক; নাগিব সাওয়ারিস, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি খাতে যুক্ত মিসরীয় কোটিপতি এবং আরি লাইটস্টোন, আব্রাহাম অ্যাকর্ডস পিস ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী।
তবে এদের কাউকেই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কোনো দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয়েছেÑ এ রকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
এদের মধ্যে আরি লাইটস্টোন মার্কিন ব্যবসায়ী ও র্যাবাই। তিনি গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে গড়ে ওঠা এই সংস্থার ত্রাণকেন্দ্রে হামলায় হাজারো মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এটিকে ‘ক্ষুধার জাল’ ও ‘পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছে।
ট্রাম্পের প্রথম আমলে লাইটস্টোন ছিলেন ইসরায়েলে মার্কিন দূত ডেভিড ফ্রিডম্যানের উপদেষ্টা। এখন তিনি ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সহযোগী। লাইটস্টোন আব্রাহাম চুক্তির আলোচনায়ও ছিলেন, যা ইসরায়েলকে কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। বর্তমানে তিনি আব্রাহাম অ্যাকর্ডস পিস ইনস্টিটিউটের সিইও।
হারেৎজের নথি অনুযায়ী, তিনি হোয়াইট হাউসের সঙ্গে মিলে গাজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কাজ করছেন। দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন সময় নয়, আগে হামাসকে সরাতে হবে।’ তার আর্থিক সম্পর্ক এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে, যারা ইসরায়েলি নীতি প্রভাবিত করত বা সরকারি সুবিধা পেয়ে থাকে। সংক্ষেপে, লাইটস্টোন ইসরায়েলপন্থি মার্কিন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, যিনি গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
তালিকায় নাম থাকা আরেকজন হলেন নাগিব সাওয়ারিস। তিনি মিশরের শীর্ষ ধনকুবের, সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। তার বাবা অনসি ওরাসকম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা মিশরের প্রথম বহুজাতিক কনগ্লোমারেট। সাওয়ারিস মূলত টেলিযোগাযোগ ও স্বর্ণের ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জন করেছেন।
টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তাদের দেখা গেছে সাওয়ারিসের ইয়টে, ব্যক্তিগত বিমানে, কায়রো, দক্ষিণ আফ্রিকা ও গ্রিসের মিকোনোসে। আফগানিস্তান পুনর্গঠনের সময়ও তিনি ব্লেয়ারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল সমর্থক। মিশরের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয়, সিসির প্রশাসনের সমালোচক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা করেছেন। আরব বসন্তের পর তিনি ‘ফ্রি ইজিপশিয়ানস পার্টি’ গড়েন।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচক সাওয়ারিস উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। ২০২৪ সালে তিনি দুবাইভিত্তিক ‘মনিফাই’ নামে একটি গণমাধ্যম চালু করলেও তা অল্প সময়ের মধ্যে ধসে পড়ে।
মার্ক রোয়ান ওয়াল স্ট্রিটের অন্যতম ধনী অর্থ লগ্নিকারী, তার সম্পদ ১০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। তিনি অ্যাপোলো গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের সিইও, যার ব্যবস্থাপনায় ৮৪০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ আছে। সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী সৌদি আরব ও আমিরাত।
রোয়ান নিজেকে ইসরায়েলের গর্বিত সমর্থক বলেন এবং গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে ‘ন্যায্য যুদ্ধ’ আখ্যা দেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলার সময় তিনি আবুধাবিতে ছিলেন এবং এটিকে ইরানের বিরুদ্ধে সমীকরণ বদলানোর সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন।
গাজায় অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ইসরায়েলি সেনাপ্রধানের বিবৃতি গাজায় অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ইসরায়েলি সেনাপ্রধানের বিবৃতি ২০২০ সালে তিনি ও তার স্ত্রী ট্রাম্পকে ১০ লাখ ডলার অনুদান দেন এবং ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ট্রেজারি সেক্রেটারি হওয়ার জন্য সাক্ষাৎকার দেন। তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় দাতা এবং ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ নিয়েও তিনি বলেন, ‘এটা ইহুদি-বিরোধিতা নয়, বরং আমেরিকা-বিরোধিতা।’
এই চারজনের তালিকায় থাকা সবচেয়ে কম বিতর্কিত ব্যক্তি হলেন সিগ্রিড কাগ। তিনি ইউরোপীয় টেকনোক্র্যাট ও নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিক। ২০২৩ থেকে ২২৫ সালের মধ্যে গাজার জন্য জাতিসংঘের সিনিয়র মানবিক ও পুনর্গঠন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, গাজা ধ্বংসপ্রায় এবং মানুষ এমনভাবে আক্রান্ত হয়েছে যে জীবিকা অযোগ্য হয়ে গেছে। কাগ ইসরায়েলের গণহত্যা ও সহায়তা বিতরণে রাজনৈতিক বাধা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এই পরিস্থিতি ‘বিশ্ববিবেকের কলঙ্ক’ এবং এটি সবার মনে দাগ রেখে যাবে।