ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাগামী সুমুদ ফ্লোটিলার জাহাজবহর থেকে অপহরণ করা ১৩৭ জনকে তুরস্কে পাঠিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। গতকাল শনিবার ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার নৌবহর থেকে প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মীকে অপহরণ করে ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ জানিয়েছে, তুরস্কে পাঠানো ১৩৭ জনের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, মরক্কো, সুইজারল্যান্ড, তিউনিশিয়া এবং তুরস্কের নাগরিক রয়েছেন।
গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ নৌ অবরোধ ভাঙা, গাজার মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া এবং সেখানকার মানুষের প্রতি অসহিংস সংহতি প্রকাশের জন্য ৪৫টি ছোট-বড় জাহাজে করে বিভিন্ন দেশের ৫০০ অধিকারকর্মী গাজার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু উপত্যকাটির উপকূলে পৌঁছার আগেই জাহাজগুলোতে হানা দিয়ে তাদের ধরে ইসরায়েলে নিয়ে যায় ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তুরস্কের বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিমান। এটির ভেতর ওই ১৩৭ অধিকারকর্মী রয়েছেন। তাদের তুরস্কের বিমানবন্দরে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। ধারণা করা হচ্ছে তুরস্ক থেকে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবেন এসব অধিকারকর্মী।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, এই ১৩৭ জনের মধ্যে ৩৬ জন তার্কিস নাগরিক। এর আগে গত শুক্রবার চারজনকে ফেরত পাঠিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, এই অধিকারকর্মীরা খুবই অল্প ত্রাণ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এগুলো ইসরায়েলের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন তারা। তাদের দাবি, অধিকারকর্মীরা ত্রাণ দেওয়ার আড়ালে উস্কানি দিতে এসেছিলেন। আটক সব অধিকারকর্মীকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছে ইসরায়েলি মন্ত্রণালয়।
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বহরের দুটি নৌযানে অবৈধভাবে ড্রোন হামলা চালাতে সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ। গত মাসের শুরুতে ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখী ওই দুটি নৌযান তিউনিসিয়ায় নোঙর করা ছিল। এ বিষয়ে অবগত মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাতে এ খবর প্রকাশিত হয়।
প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি না থাকায় ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী একটি সাবমেরিন থেকে ড্রোন উড়িয়ে তিউনিসিয়ার সিদি বো সাঈদ বন্দরের বাইরে নোঙর করা নৌযানগুলোতে দাহ্য সরঞ্জাম ফেলে। এতে সেগুলোতে আগুন ধরে যায়। গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর একটি পর্তুগিজ পতাকাবাহী নৌযান এবং একটি ব্রিটিশ পতাকাবাহী নৌযানকে আলাদা করে নিশানা করা হয়েছিল। তবে ওই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সশস্ত্র সংঘাত সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, যেকোনো পরিস্থিতিতেই বেসামরিক মানুষ বা বেসামরিক স্থাপনার ওপর দাহ্য সরঞ্জাম দিয়ে হামলা নিষিদ্ধ। নেতানিয়াহু এ ব্যাপারে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আটক অভিযাত্রীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে কারাগারে পাঠাতে চান বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতমার বেন-গিভর। গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় এই আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন তিনি।
এক্সবার্তায় তিনি বলেন, ‘ফ্লোটিলার আটক অভিযাত্রীদের যদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানÑ তাহলে আবার তারা ফিরে আসবে, বারবার আসবে। আমার মনে হয়, এখনই দেশে না পাঠিয়ে কয়েক মাস তাদের ইসরায়েলের কারাগারে রাখা উচিত। এতে তারা সন্ত্রাসীদের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।’ এর আগে এক্সে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় ফ্লোটিলার অভিযাত্রীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন বেন-গিভর।
ফ্রিডম ফ্লোটিলার সব নৌযান একসঙ্গে গাজার পথে এগোচ্ছেÑ ফেসবুকে শহিদুল আলম : দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম গতকাল শনিবার দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছেন, গাজা অভিমুখে থাকা কনশানস নৌযানটির সামনে থাকা বহরের অন্য আটটি নৌযানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। কনশানস নৌযানের গতি বেশি হওয়ায় এমনটা সম্ভব হয়েছে। এখন কনশানসের গতি কমিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সব নৌযান একসঙ্গে গাজা অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি কনশানস নৌযানটিতে আছেন।
পোস্টে শহিদুল আলম লিখেছেন, ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস একটি অবিস্মরণীয় ধারণা। জাতিগত নিধন ঠেকাতে বিশ্বনেতাদের পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়তা এবং কপট ভূমিকার কারণে বিশ্বের জনগণ নিজেরাই পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাজারো জাহাজের ধারণাটি প্রতীকী। তবে নিঃসন্দেহে এভাবে একত্র হওয়া সমুদ্রযানের সবচেয়ে বড় বহর এটি।’
শহিদুল আলম কনশানস নামের যে নৌযানটিতে অবস্থান করছেন, সেটিকে তিনি ওই বহরের সবচেয়ে বড় নৌযান বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এটি সবার শেষে (৩০ সেপ্টেম্বর) ইতালি থেকে রওনা করেছিল। আর কনশানসের আগে ওই আটটি নৌযান রওনা করেছিল। এ ছাড়া আরও দুটি নৌকাও আগে ছিল। তবে ওই দুটি নৌকার অবস্থান এখনো নিশ্চিত নয়। কনশানস সবার শেষে রওনা করলেও এটির গতি বেশি হওয়ায় আগে রওনা করা আটটি নৌযানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন কনশানসের গতি কমানো হয়েছে এবং সব নৌযান একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে।
গাজার অবরোধ ভেঙে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে শহিদুল আলম লিখেছেন, ‘আমরা কনশানসের মানুষেরা অবরোধ ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা যদি আমাদের আটকায়, তখন অন্যরা এগিয়ে আসবে। দমন-পীড়নকারী কখনোই জনগণের শক্তির বিরুদ্ধে টিকতে পারেনি। ইসরায়েলও ব্যর্থ হবে। মুক্ত হবে ফিলিস্তিন।’