ঢাকা রবিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৫

রাজশাহীর সবুজে কুঠারাঘাত!

জনাব আলী, রাজশাহী
প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ১১:৫৫ পিএম
  • ৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য কাটা হচ্ছে ২,৩২৩টি গাছ
  • মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে কাটা হবে ১,৮৫৩টি গাছ
  • পাইপলাইন স্থাপনে সওজের জায়গায় ৪১৮টি গাছ নিধন
  • পরিবেশবাদীদের স্মারকলিপি ও প্রতিবাদের ঘোষণা

রাজশাহীতে তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাটা পড়ছে সহস্রাধিক গাছ। এতে হুমকির মুখে পড়েছে রাজশাহীর প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ। তবে গাছ কেটে বা জলাধার ভরাট করে কোনো উন্নয়ন চায় না রাজশাহীর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। বিষয়টি নিয়ে স্মারকলিপি ও প্রতিবাদের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনগুলো।

রাজশাহীতে এমনিতেই শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রার পারদ চরম মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তাই তিন প্রকল্প যথাÑ রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ, ওয়াসার নতুন পাইপলাইন স্থাপন এবং রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্প্রসারণ বাস্তবায়ন চূড়ান্ত করতে কাটা পড়ছে প্রায় সহ¯্রাধিক বৃক্ষ কাটার পরিকল্পনায় রাজশাহীর প্রকৃতি ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। আবাসস্থল হারাচ্ছে প্রাণিকূল। তাই গাছ কেটে বা জলাধার ভরাট করে কোনো উন্নয়ন চান না বৃক্ষ রাজশাহীর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরী সংলগ্ন সিলিন্দা ডাবতলা এলাকায় রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) কর্তৃপক্ষ স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৫৩টি গাছ কাটতে চান। ইতিমধ্যে সেখানে বেশকিছু গাছ কাটা হয়েছে। নগরীতে পদ্মা নদী থেকে পরিশোধিত পানি সরবরাহের জন্য রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) নতুন পাইপলাইন স্থাপনের জন্য ৪১৮টি গাছ কাটছে সড়ক বিভাগ। গোদাগাড়ী থেকে রাজশাহী নগরী পর্যন্ত সড়কের ধারে এই পাইপলাইন স্থাপনের জন্য এসব গাছ কাটা শুরু হয়েছে।  এ ছাড়া রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্প্রসারণে আর ৫২টি গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে সার্কিট হাউস কর্তৃপক্ষ। এই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাটা হচ্ছে মোট ২ হাজার ৩২৩টি গাছ।

এসব বৃক্ষ কেটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিপক্ষে রাজশাহীর বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। অবিলম্বে এসব বৃক্ষ নিধন থেকে বিরত থাকতে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান তারা। আজ রোববার রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারকে গাছ কাটা থেকে সরে আসতে স্মারকলিপি প্রদান করবেন বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর ইয়ুথ ফোরামের সদস্য সচিব ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ সংহতির সদস্য আতিকুর রহমান। 

আতিকুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজশাহীর চরমভাবাপন্ন আবহাওয়াকে স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন সবুজ বেষ্টনী ও প্রচুর জলাধার। কিন্তু উন্নয়ন এর তকমা লাগিয়ে রাজশাহীর প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর আঘাত হানা হয়েছে বহুবার। এ ধরনের অপরিকল্পিত উন্নয়ন মানুষের জীবন-জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করছে এবং অন্যান্য প্রাণীদের আবাসস্থল ও অধিকার হরণ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।

গাছ কেটে বা জলাধার ভরাট করে কোনো উন্নয়ন আমরা চাই না। যেখানে ২৫ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন, রাজশাহীতে সেটা রাখতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বড় বড় বৃক্ষ কমে যাওয়ার কারণে আবাসস্থল হারিয়ে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী সার্কিট হাউসের ছয়তলা ভবন, একটি চারতলা ব্যারাক এবং একটি একতলা কিচেন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে গণপূর্ত বিভাগ। ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ জন্য সেখানে ৫২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্প্রতি গাছগুলো মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু এই গাছ না কাটার বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা গণপূর্তে গিয়ে অনুরোধ করেছেন। এ জন্য এখনো সেখানে গাছ কাটা শুরু হয়নি।

অপরদিকে, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা নদী থেকে রাজশাহী নগরে পানি আনার জন্য রাজশাহী ওয়াসা ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকার ‘পানি শোধনাগার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য বসাতে হচ্ছে ২৬ কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন। পাইপ বসানোর জন্য কোনো জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়নি। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশ দিয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জায়গায় পাইপ বসানো হচ্ছে। এ কারণে সওজ নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থেকে পশ্চিমে নতুন কসবা, কসবা গোরস্থান হয়ে এইচবিবি রাস্তার পাশ পর্যন্ত ডান দিকের (উত্তর পাশের) থাকা কড়ই, মেহগনি, আকাশমণিসহ নানা প্রজাতির ৩০৬টি গাছ কেটে ফেলেছে।

মহাসড়কটি আগে সবুজে ঢাকা থাকলেও প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। একই প্রকল্পের জন্য গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি এলাকায় ১১২টি গাছ নিলামের আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। ওয়াসা এসব গাছ কেটে সওজের কাছে জমা দিয়েছে। সওজ ৩০৬টি গাছ নিলাম করার সময় একটি লটে এই গাছগুলোও রেখেছে। মোট ১৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় ৪১৮টি গাছ সম্প্রতি নিলামে বিক্রি করা হয়। এখন ৮৪টি গাছ কাটার কাজ চলছে।

সচেতন নগরবাসী এমএ কাইউম জানান,  রাজশাহী গোদাগাড়ি সড়কে চলাচলের সময় গাছের ছায়া পথচারী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। এসব বৃক্ষ নিধনের ফলে সড়ক ফাঁকা হয়ে গেল। ছোট-বড় গাছ যা আছে, সবই কেটে নেওয়া হচ্ছে।  এভাবে গাছ কেটে ফেলা ঠিক না বলে দাবি করেন তিনি। 

রাজশাহী সওজ বিভাগের নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ মীর মুকুট মো. আবু সাঈদ বলেন, ‘ওয়াসা যখন প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ভূমি অধিগ্রহণের কোনো বাজেট রাখা হয়নি। সওজের জায়গায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে মহাসড়কের পাশে যেখানে সওজের জায়গা কম, সেদিক দিয়ে পাইপলাইন নেওয়ার জন্য গাছ কাটতে হচ্ছে। যেখানে জায়গা বেশি আছে, সেখানে গাছে হাত দেওয়া লাগেনি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘নিলাম করতে দেরি হচ্ছিল বলে ওয়াসা নিজেই আগে ১১২টি গাছ কেটে আমাদের জমা দিয়েছে। আর একটি লটে আমি ৮৪টি গাছ কাটার কার্যাদেশ দিয়েছি’। ওয়াসা যদি এখনো জমি অধিগ্রহণ করে, তাহলে এখনো চার লটের বাকি ২২২টি গাছ রক্ষার সুযোগ রয়েছে। এগুলোর কার্যাদেশ হয়নি বলে জানান তিনি। 

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য রাজশাহী নগরী সংলগ্ন বাজেসিলিন্দা মৌজায় অধিগ্রহণ করা হয় ২০৫ জমি। সেখানে রয়েছে আম, কাঠাল, জাম, মেহগনিসহ বিভিন্ন ফলজ ও সবুজ বৃক্ষ। সম্প্রতি দরপত্র ছাড়াই ক্যাম্পাস থেকে সহস্রাধিক গাছ কেটে নিয়ে গেছে একটি চক্র। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।

এ প্রসঙ্গে রামেবির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোহা. জাওয়াদুল হক বলেন,  ‘দরপত্র ছাড়া অবৈধভাবে গাছ কাটার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি ছুটি শেষেই দ্রুত তারা প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ মুখ্য বিষয়। তাই ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ দ্রুত করতে কিছু গাছ কাটতে হচ্ছে’। 

তিনি আরও বলেন, ‘সকলের মতামত নিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে। তবে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পাসে ৪৯ শতাংশ গ্রিন জোন করা হবে। আমরা ১ হাজার ৮৫৩টি গাছ কাটছি, সেখানে  দ্বিগুণ পরিমাণে প্রায় ২ হাজার ৩০০ গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করব’। 

এদিকে প্রকল্পের নামে সহ¯্রাধিক গাছ কাটার বিরুদ্ধে  রাজশাহীর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বৈঠক করেছেন। বৈঠকে পরিবেশকর্মী, গবেষক, আইনজীবীসহ অনেকেই মতামত দেন। তারা গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন।