২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। আপাতত রুদ্ধশ^াস অপেক্ষার অবসান ঘটল সুইডিশ কমিটির এই ঘোষণায়। অবসান ঘটল অনেক জল্পনা-কল্পনার। ২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তির ঠিক এক দশক পরে তিনি সাহিত্যের সবচেয়ে মর্যাদাকর এই পুরস্কার জিতলেন। বুকার পাওয়ার পর তার কিছু গল্প অনূদিত হলেও সম্প্রতি তাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। এমনকি অক্টোবর মাস শুরুর আগে আগে সম্ভাব্য নোবেল লরিয়েট হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয়, সেখানেও তিনি ‘হিট লিস্টে’ ছিলেন না।
প্রথা অনুযায়ী ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে নোবেল পাওয়া সাহিত্যিকের রচনার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘তার সেই দৃষ্টিনন্দন, বিষণœ অথচ মহিমান্বিত গদ্য রচনার জন্য, যা বিশৃঙ্খলা ও ভয়ের মধ্যেও মানবতার শিল্পসত্তাকে পুনরুজ্জীবিত করে।’
তার রচনাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে এ কথাগুলোরই যথার্থ অনুরণন অনুভূত হয়। প্রথম উপন্যাস থেকেই তিনি তার অনুরণিত কম্পন দেখিয়ে আসছেন। সাটানটাঙ্গো (১৯৮৫) প্রকাশের পরপরই ইউরোপীয় পাঠকসমাজের নজর কাড়েন তিনি। আপাত দুর্বোধ্য গদ্যের ভেতরে ঠেসে দেন মন্ত্রমুগ্ধকর মনোবিশ্লেষণ। অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া মানুষগুলো আ্যধ্যাত্মিকভাবেও নিঃস্ব হয়ে যায়। জাগতিকতা যখন নিঃশেষের পথে, তখন মানুষ হিসেবে অজাগতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ার কথা।
মানুষগুলো সেখানেও কুণ্ঠিত। অনেক আশার সমাজতন্ত্র যখন পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন ওই মানুষগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তিনি এভাবেই করেছেন। ১৯৫৪ সালে রোমানিয়ার সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহরে জন্ম নেওয়া এই কথাসাহিত্যিকের প্রথম উপন্যাসের পটভূমিও ছিল ছোট্ট একটা গ্রাম। কিন্তু সেটাই যেন হয়ে উঠেছিল পতনোন্মুখ সমাজের আর্ত প্রতিচ্ছবি। সাটানটাঙ্গো নিয়ে পরিচালক বেলাটার সিনেমা বানান, যা বিশ^ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্ল্যাসিক হিসেবে পরিগণিত।
এরপর বের হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স (১৯৮৯)। পাহাড়ে অবস্থিত একটা ছোট শহর কার্পাথিয়ানে প্রবেশ করে এক বিকট সার্কাস দল, যার মূল আকর্ষণ একটা বিশাল তিমি মাছের মৃতদেহ। এ ঘটনা শহরের ভেতরে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। নাান রকম ধ্বংসাত্মক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবং তা প্রায় অভ্যুত্থানের পর্যায়ে যায়। সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের দ্বন্দ্ব যেখানে লেখকদের রচনার অন্যতম উপলব্ধি, সেখানে লাসলো দেখালেন শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার দ্বন্দ্ব। তার নৃশংস রূপ।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন সরকারি কর্মচারী। তার চোখ দিয়ে দেখা হয় মানবতার শেষ সংগ্রাম। যুদ্ধের মধ্যে শান্তির অন্বেষায় মরিয়া এই ব্যক্তি টিকে থাকার উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত অন্য দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
এই উপন্যাসের পরবর্তী অংশ মনে করা হয় ২০১৬ সালে প্রকাশিত ব্যারন ভেঙ্কহেইমস হোমকামিং উপন্যাসকে। আর্জেন্টিনায় বহু বছর কাটিয়ে হাঙ্গেরিতে ফিরতে থাকা প্রধান চরিত্র জুয়ার আসক্তিতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক জমিদার। ২০২১ সালে প্রকাশ পায় তার সাম্প্রতিকতম বই হেরস্ট ০৭৭৬৯। এই বইয়ের দৃশ্যপট পূর্ব জার্মানির থুরিঙ্গিয়ার একটা ছোট শহর। সমসাময়িক সংকট, বাস্তবতা ও সামাজিক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ এই শহর। স্বভাবতই শান্তির অংশ হিসেবে পরিগণিত এই চরিত্র একসময় বুঝতে পারে তিনি আসলে ধ্বংসাত্মক শক্তির অংশ হয়ে গেছেন। এর চেয়ে বড় সংকট ও বিপর্যয় আর কী হতে পারে!
তার রচনাগুলো পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাবে কাফকার কথা। টামাস বার্নহার্ডের কথা। এমনকি হেমিংওয়ের কথাও। তবে আদতে তিনি কোনোটাই নন। কারণ কণ্ঠস্বরটি একান্তই তার। তাইতো সুসান সানটাগ তার লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘সর্বনাশের মাস্টার’। তাকে প্রায়ই শুনতে হয় তার গদ্য যেন ‘অবিরাম বাক্যের নদী’।
সবকিছু মিলিয়ে তার সাহিত্য আসলে অস্তিত্ববাদী সংগ্রামের মঞ্চ, যেখানে মন্ত্রমুগ্ধকর গদ্য নিয়ে সর্বদা হেঁটে বেড়ান তিনি প্রান্ত থেকে প্রান্তে।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক