সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ১১:৫৬ পিএম

গুম কমিশনের প্রামাণ্যচিত্র

গুম হওয়া সবারই ছিল  আলাদা ‘কোড নেম’

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ১১:৫৬ পিএম

গুম হওয়া সবারই ছিল  আলাদা ‘কোড নেম’

  • নৌকায় গুলি করে বেশির ভাগ লাশ ফেলা হতো মাঝনদীতে
  • বিষ প্রয়োগ, চলন্ত ট্রাকের সামনে ও রেললাইনে ফেলেও হত্যা  
  • সুন্দরবনের দস্যুদের ট্রলার নিয়ে মিশন চালাত জিয়াউল আহসান 

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শত শত মানুষ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এ ক্ষেত্রে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আলাদা ‘কোড নেম’ ছিল। ভুক্তভোগীকে কখনো কখনো ‘মোরগ’, কখনো বা ‘প্যাকেট’, আবার কখনো কখনো ‘সাবজেক্ট’ বলা হতো। বিশেষ বন্দিদের ডাকা হতো ‘মোনালিসা’ নামে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালাতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভুক্তভোগীদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। প্রথমদিকে হত্যা করে লাশ রাস্তাঘাটে ফেলা হলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে লাশ গুম করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের নৌকায় করে মাঝনদীতে নিয়ে গুলি করে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। এ ছাড়া বিষ প্রয়োগ, ইনজেকশন পুশ ও রেললাইনে ফেলেও হত্যা করা হয়েছে অনেককে। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রমাণ্যচিত্র, তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে এসব ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মূল ভূমিকায় ছিল- র‌্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই। এসব বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হতো। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রামাণ্যচিত্রে। এতে জানা গেছে, কারা গুম করত, কীভাবে করত, গুমের পর নিখোঁজদের কোথায় এবং কীভাবে আটকে রাখা হতো, তাদের পরিণতি কী হতো এবং কারা কারা এ কাজে সরাসরি জড়িত ছিল। প্রামাণ্যচিত্র উঠে এসেছে, প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের আগে গুমের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেত। এসব গুম ও হত্যার সবই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই হয়েছে বলে মনে করছে গুম কমিশন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সুন্দরবনের দস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করা একটি ট্রলার আনা হয়েছিল। জিয়াউলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অনেক মানুষকে গভীর রাতে ওই ট্রলারে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলা হতো নদীতে। 

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছেন, ভুক্তভোগীদের একটা বড় অংশ আছে যাদেরকে বেশ কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর অথবা কয়েক দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতোÑ কাদের হত্যা করা হবে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের কখনো কখনো মোরগ বলা হতো, কখনো বা প্যাকেট বলা হতো, আবার কখনো কখনো সাবজেক্ট বলা হতো। যখন ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকা-ের বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমালোচনা তৈরি হয়, তখন এসব কর্মকা-ে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নানা কৌশলে লাশ গুম করা শুরু করেছিল। 

প্রামাণ্যচিত্রে গুম কমিশনের সদস্য নুর খান লিটন বলেন, ঊর্ধ্বতন অনেক অফিসার আছেন বা যারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিচালনা করতেন, তাদের নির্দেশনায় এবং তাদের উপস্থিতিতেই ভুক্তভোগীদের নিয়ে যাওয়া হতো মাইক্রোবাসে করে। টঙ্গী থেকে রওনা দেওয়ার পর যতগুলো ব্রিজ আছে, প্রায় প্রতিটি ব্রিজের গোড়ায় নিয়ে র‌্যাবে বা র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার নতুন যারা অফিসার সংযুক্ত হতেন- তাদের বলা হতো দুজন-একজন ‘মোরগ’ বা ‘প্যাকেট’ নামাওÑ গুলি করো। তিনি বলেন, প্রথমদিকে কিছু লাশ রাস্তাঘাটে পাওয়া যেত, ফেলে যেত। যখন এই বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে কানাঘুষা হতে লাগল, তখন কিন্তু আর রাস্তাঘাটে লাশ ফেলত না।

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেন, তাদের একটা বেশ কমন মেথড ছিল। যেটা গোটা দেশে ব্যবহার করা হতো, সেটা হলো ভুক্তভোগীকে নৌকা বা ট্রলারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা। 

প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন র‌্যাবে সংযুক্ত সামরিক বাহিনীর এক সদস্য বলেন, ডেস্টিনেশনটা আগে থেকে বলা হতো না যে, কোথায় যাব। নৌকায় ওঠার পরে স্যার বলত, সাউথের দিকে যাও। কিছুদূর যাওযার পরে বলেন, ‘স্লো ডাউন’। তখন বুঝি যে, এখনই প্রক্রিয়া শুরু হবে। যখন ট্রলারের খোলের মুখটা খুলে একজন করে ভুক্তভোগীকে তুলতেছে আর ট্রলারে থাকা সিমেন্টের বস্তা দিয়ে বেঁধে ফেলতেছে। বাঁধে হাঁটু বরাবর। বেঁধে পায়ের কাছে সিমেন্টের বস্তাটা একদম ট্রলারের কর্নারে রাখে। 

তিনি বলেন, স্যারের পছন্দের জায়গা হলো মাথা। মাথার একপাশে বালিশ ঠেকিয়ে তারপর সেকেন্ডম্যান এক রাউন্ড বা দুই রাউন্ড ফায়ার করত। দুই রাউন্ড ফায়ারের প্রয়োজনটা কখন হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কমিশনকে বলেন, যদি কখনো স্যারের মনে হয়েছে, কারো হাত কেঁপে গেছে, তখন উনি (স্যার) বলতেন ‘সেকেন্ড শট’। 

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, আগে থেকেই সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে রশি বাঁধা থাকে। তারপর বাকি রশিটা কোমরের সঙ্গে বেঁধে ভুক্তভোগীকে শুইয়ে দেওয়া হয়। তারপরে গুলি করে লোয়ার পোর্শন ধরে ফেলে দিল। 

কে ফেলল? এমন প্রশ্নে উত্তরে তিনি কমিশনকে বলেন, জিয়াউল তো গুলি করল। এখন জিয়াউলই ফেলল না সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা ফেলল, এটা আমার খেয়াল নেই।  

প্রমাণ্যচিত্রে বলা হয়, গুলি করে মেরে ফেলার পরে পেটটা চিরে দেওয়া হতো এবং বডির সঙ্গে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে দেওয়া হতো বা ইটের বস্তা। যাতে ভুক্তভোগীকে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া পরে যাতে ডুবে যায়। 

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়ে উল্লেখ করে গুম কমিশনের সদস্য নুর খান বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এবং তাদের লাশ লুকিয়ে ফেলার যে প্যাটার্ন, এই প্যাটার্নের সঙ্গে অনেক অংশে মিলে যায় অন্যান্য গুমের ঘটনা। 

বিভিন্ন বর্ণনার কথা উল্লেখ করে নূর খান বলেন, নানাবিধ টেকনিক ছিল মারার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষ প্রয়োগ করেও হত্যা করা হয়েছে। ইনজেকশন দিয়ে মরা হতো। এটার বর্ণনা পেয়েছি আমরা, যারা এটা নিজে চোখে দেখেছে। 

প্রামাণ্যচিত্রে র‌্যাবে সংযুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, হ্যাঁ, ইনজেকশন পুশ করা হতো। অনেক সময় গাড়িতেই ইনজেকশন পুশ করত স্যার। স্যার নিজেই পুশ করতেন।  

গুম কমিশন জানায়, একজন মানুষকে মেরে ফেলে তার লাশটা রেললাইনে ফেলে দেওয়া হতো। মানুষ রেললাইনে কাটা পড়েছে এই হিসেবে জিনিসটাকে প্রতীয়মান হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, অনেক সময় লাশের হাতে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় লাশ পাওয়া গেছে। তো বোঝাই যাচ্ছে, কী হয়েছে। না হলে হ্যান্ডকাফ এলো কোথা থেকে? প্রশ্ন কমিশনের। 

কমিশন জানায়, একজন ভুক্তভোগী বেঁচে ফিরেছেন যাকে ট্রাকের সামনে ফেলে মারার চেষ্টা হয়েছিল। এ রকম অনেকাংশেই তারা সফলও হয়েছে। 

৩৫ বছর বয়সি এক ভুক্তভোগী যুবক ডিবি কর্তৃক অপহৃত হন। তিনি ৮ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ওই ভুক্তভোগী যুবক বলেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় আব্দুল্লাহপুর আশুলিয়া রোডে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়ার পরে গাড়িতে থাকা অন্যদের উনি (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা) নেমে যেতে বলেন, তারা নেমে যান। পরে আমাকে কানে কানে বলতেছে, ভাইজান আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। দেখেন আপনাকে তো চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ করেই আমাকে ধাক্কা দেওয়া হলো এবং আমি খেয়াল করতেছিলাম যে, গাড়ির শব্দ আসতেছে। আমি তখন ধরেই নিয়েছি যে আমি শেষ। পরে যাওয়ার পরেও দেখতেছি আমি বেঁচে আছি। আমারে তুলে ধরে বলছে যে, আপনি ভয় পাইয়েন না। আপনাকে তো আমরা রাস্তায় ফেলে দিয়েছি; কিন্তু গাড়িটা পাশ দিয়ে চলে গেছে। তবে আমি টের পেয়েছিলাম যে গাড়িটা যখন জোরে খুব রানিংয়ে আসতেছে। আমারে যখন ফেলে দেয়, তখন ব্রেক শক্ত করে ধরে পাশ দিয়ে ট্যাঁ করে শব্দ হয়, সেটা ঠিক সেই শব্দটাই আমার কানে আসছে। 

নূর খান বলেন, আমাদের কাছে যারা মুখ খুলেছেন, এটাই পূর্ণাঙ্গ তথ্য না। এর কয়েক গুণ এখনো সমাজে রয়েছে, যারা এখনো আস্থা বা সাহস পাচ্ছেন না এই বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলতে বা তারা অভিযোগ করতে। তারা মনে করেন, এমনিই আমরা মামলা-মোকাদ্দমার ভেতর আছি। তারপর আবার এটা করতে গিয়ে কোন ফ্যাসাদে পড়ব। আবার কোন ভোগান্তি হবে। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা ট্র্যাইব্যুনালে ধরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, গুমের শিকার ব্যক্তির হাত কেটে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলা, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে কিংবা ইলেকট্রনিক শক দিয়ে লোমহর্ষক সব নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া গুমের শিকার বন্দিদের আলাদা ‘কোড নেইম’ ছিল। বিশেষ বন্দিদের ডাকা হতো ‘মোনালিসা’ নামে। আর গুম ঘরকে বলা হতো ‘আর্ট গ্যালারি’, যা পরবর্তী সময়ে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে, গোপন বন্দিশালাগুলোকে হাসপাতাল বা ক্লিনিক নামে ডাকা হতো। আর গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের বলা হতো সাবজেক্ট।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!