সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রহিম শেখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৫, ১২:০১ এএম

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ

এক ক্লিকেই ‘ফাঁদ’

রহিম শেখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৫, ১২:০১ এএম

এক ক্লিকেই ‘ফাঁদ’

মাত্র পাঁচ দিনে শেয়ারবাজারে বড় মুনাফার প্রতিশ্রুতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বুস্ট করা বিজ্ঞাপনে ক্লিক করতেই চলে যাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। যেখানে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন দেশের নামকরা একজন অর্থনীতিবিদ। পরামর্শ দিচ্ছেন পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের একটি দল। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া হচ্ছে ভুয়া ওয়েবসাইটের লিঙ্ক। তারপর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত সব তথ্য। শেষ ধাপে বলা হচ্ছে বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠাতে। এভাবেই গড়ে উঠেছে এক বহু-প্ল্যাটফর্ম প্রতারণার জাল। যে জালে আটকে যাচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। রূপালী বাংলাদেশের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। 

অনুসন্ধানে অন্তত অর্ধশতাধিক ফেসবুক পেজ খুঁজে পাওয়া গেছে যেখানে এমন অভিনব প্রতারণা চলছে। নতুন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ শনাক্ত করা হয়েছে যেখানে সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে হবে ৩০ হাজারের বেশি। গ্রুপগুলো চালানো হচ্ছে দেশের বেশ কয়েকটি নামকরা ব্রোকারেজ হাউসের নামে। এগুলো হচ্ছেÑ সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড (সিবিএল), ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজ, আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এমটিবি সিকিউরিটিজ, শেলটেক ব্রোকারেজ এবং ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেড। গ্রাহক সেজে একাধিক গ্রুপে যোগ দিয়ে গোটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে রূপালী বাংলাদেশ। গ্রুপগুলোতে বিনিয়োগকারীদের পাঠানো হয় একটি ভুয়া অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের লিঙ্ক এবং ভুয়া ওয়েবসাইটের ঠিকানা। তারপর ব্যাংক এবং বিকাশ ও নগদের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা লেনদেন করা হয়। এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে প্রতারকেরা বৈধ ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্ট এড়িয়ে সরাসরি নিজেদের পকেটে টাকা তুলছে। বিজ্ঞাপনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতো বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি ও পরিচয় ব্যবহার হচ্ছে।  

ব্র্যাক ইপিএলের নাম ব্যবহার করে চালানো পাঁচটি গ্রুপে প্রবেশ করে দেখা গেছে, প্রতিটিতে ঠিক বেলা ১১টায় একটি টিপস বা পরামর্শ আসে, প্রতিটিতেই ‘আফরিন জাহান’ নামে একজন নিজেকে ব্র্যাক ইপিএলের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন এবং প্রতিটি গ্রুপেই অ্যাডমিনদের মেসেজ বা বার্তার ভাষা হুবহু একই। সিবিএলের নামসহ একটি গ্রুপে যোগ দিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পরামর্শ দিচ্ছেন ব্রোকারেজটির কর্মকর্তা দাবি করা জহিরউদ্দিন শাহ ও অন্বেষা বসু। এই গ্রুপের বার্তা বা ভাষার সঙ্গে ব্র্যাক-ইপিএল নামসহ গ্রুপগুলোর বার্তার মিল নেই। দুই অংশের মধ্যে সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় প্রচারণা কৌশলে। অন্তত সাতটি ফেসবুক পেজ পাওয়া গেছে যারাÑ সিবিএল ও ব্র্যাক ইপিএল দুই ধরনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের প্রচারণা চালিয়েছে। দুই অংশের প্রচারণাতেই প্রায় একই গ্রাফিক্স কার্ড ও বার্তা ব্যবহারের আধ ডজন নজির পাওয়া গেছে। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঘুরে ফিরে একই ফেসবুক পেজ এই প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে এবং প্রতি সপ্তাহে তারা নতুন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলছে এবং তাতে শত শত ব্যবহারকারী যোগ দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপনের ধরন কমবেশি একই, শুধু সপ্তাহে সপ্তাহে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি বদলে যাচ্ছে। গ্রাফিক্স কার্ড ও তথ্য একই, কিন্তু এর অ্যাপ্লাই নাও বাটনে অনুসরণ করে ব্র্যাক নামসহ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পাওয়া যায়। দুটো বিজ্ঞাপনই চলেছে এনি ডেবিস নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিবিএলপিজি নামের অ্যাপটি অন্তত ১২শ বার ডাউনলোড হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায়, কত ব্যক্তি এই স্কিমে বিভ্রান্ত হয়েছেন। ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী আহসানুর রহমান জানিয়েছেন, এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই; এটি এক ধরনের প্রতারণামূলক স্কিম এবং এর কারণে তাদের অনেক গ্রাহক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এটি তাদের সুনামের ক্ষতি করছে বলেও জানান তিনি। সিটি ব্রোকারেজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারাও এই প্রতারণা নিয়ে শঙ্কিত এবং বিষয়টি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুলিশকে জানিয়েছেন। 

বি-সেভেন সেভেন ব্রাক ইপিএল এআই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম স্ক্রিনশটে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের আগমন বার্তা জানাচ্ছেন নুসরাত জাহান নামে এক নারী। গ্রুপে বার্তা এলো, আগামী সপ্তাহেই আসছেন ড. জাহিদ হোসেন; তিনি এই গ্রুপে সবাইকে ‘লাইভ’ প্রশিক্ষণ দেবেন, যেন শেয়ার বেচাকেনায় লোকসান কমিয়ে, মুনাফা ঘরে তোলা যায়। বার্তাটি দিয়েছেন, নুসরাত জাহান। তিনি বলছেন, ড. জাহিদ তার শিক্ষক, যিনি একটি সম্মেলনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই শিক্ষকের সহকারী হিসেবে তিনি এত দিন গ্রুপ সদস্যদের দৈনিক আপডেট দিয়ে গেছেন।

ড. জাহিদের আগমনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘সাজিদ চৌধুরি’ নামের একজন বিনিয়োগকারী আলোচনায় যোগ দেন। তিনি গ্রুপে একটি খবরের লিংক দিয়ে বললেন, ‘আমিও ড. জাহিদ হোসেনের লেটেস্ট নিউজ দেখছি, তাই এই গ্রুপে জয়েন করে শিখতেছি।’ খবরটির মূল বিষয়বস্তু হলো, ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি ‘এআই কোয়ান্টিটেটিভ ট্রেডিং প্রমোশন সম্মেলন’ হবে , যা ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ আয়োজন করছে, বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে। এতে ড. জাহিদ সভাপতিত্ব করবেন। এরপর একের পর এক বার্তা আসতে থাকে, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে ড. জাহিদের ফেরার অপেক্ষায় আছি’, ‘সো কুল! ড. জাহিদ হোসেন যখন আমাদের গাইড করছেন, আমরা ট্রেডিংয়ে অনেক বেশি স্টেডি হবো,’ ইত্যাদি। এদের কারো নাম সুমাইয়া আক্তার, কারো নাম নওশিন জাহান বা আশিকুর রহমান।

গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় ড. জাহিদ পরিচয় দিয়ে একজন ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এলেন এবং লিখলেন : ‘প্রিয় বন্ধুদের! আমি জাহিদ হোসেন, বর্তমানে ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজ চিফ এনালিস্ট। প্রতিদিন এখানে আপনাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার জন্য খুবই মূল্যবান।’ তিনি আরও জানালেন, বিশ্বব্যাংক থেকে অবসার নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের পুঁঁজিবাজারের উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন এবং আশা করছেন এই গ্রুপে বিনিয়োগকারীদের ‘ভবিষ্যৎভিত্তিক বাজার বিশ্লেষণ’ দিতে পারবেন। ঠিক একই ম্যাসেস দেওয়া হলো অন্তত ১২টি গ্রুপে। রূপালী বাংলাদেশ সব গ্রুপ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, ছবির ব্যক্তি এক হলেও আলাদা আলাদা নম্বর দিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে। রূপালী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি নম্বরেই সরাসরি কল এবং হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হয়, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। 

ড. জাহিদ হোসেন একজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ এবং তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে আছেন। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি জানান, এসব গ্রুপ বা বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি জানান, কথিত সেই সম্মেলনের খবরটি ভুয়া এবং তিনি নিজেও ফেসবুকে এমন বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হয়েছেন। ড. জাহিদ সবাইকে এই ধরনের প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের বিনিয়োগের আগে অবশ্যই যাচাই বাছাই করা উচিত। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আইডিএলসি ব্রোকারেজের নাম ব্যবহার করা গ্রুপটিতে গত ৮ অক্টোবর নতুনভাবে ‘কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভ’-এর ধারণা আনা হয়।

সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে ‘ফেরদৌস রহমান’ ঘোষণা দেন, সিবিএল মেম্বারশিপ সার্ভিসের কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কয়েক মিনিট পর, তিনি নিজেকেই সেই কাস্টমার প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন এবং একটি লিংক শেয়ার করেন। লিংকে ক্লিক করলে নতুন একটি চ্যাট উইন্ডো খোলে, যেখানে ‘কাস্টমার সার্ভিস নং-০৪২’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট আগে থেকেই ‘হ্যালো, আই উড লাইক টু অ্যাপ্লাই ফর এ মেম্বারশিপ’ (মূল ইংরেজিতে) লেখা একটি স্বয়ংক্রিয়-মেসেজ যুক্ত করে রেখেছিল। সেই বার্তা পাঠানোর পর আইডিএলসি সিকিউরিটিজ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হয় এবং জানানো হয় ‘১৫ দিনের মধ্যে ৩০% থেকে ৮০% পর্যন্ত রিটার্ন’ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আগ্রহ দেখালে তিনি গুগলের প্লে স্টোর থেকে ‘আইডিএলসি’ নামের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলেন। অ্যাপ ইনস্টল করার পর নিবন্ধন। এজন্য একটি মোবাইল নম্বর, ছয় অক্ষরের পাসওয়ার্ড, ক্যাপচা এবং ‘অফিসিয়াল কোড’ পূরণ করতে হয়। কোডটি দেন সেই কাস্টমার প্রতিনিধি। নিবন্ধন শেষে অ্যাপে প্রবেশ করা যায়। অ্যাপটিতে সিটি ব্রোকারেজের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন স্লাইড দেখানো হয়। সেখানে আইপিও, ব্লক ট্রেড, লোন, ডিপোজিট, উইথড্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ওয়ালেটের মতো ফিচার দেখা যায়। টাকা জমা দেওয়ার জন্য বিকল্প দুটি: ব্যাংক ও ওয়ালেট।

ন্যূনতম জমার পরিমাণ হলো ৫০০০ টাকা। অন্য ব্রোকারেজ হাউসের নাম ব্যবহার করা গ্রুপগুলোতেও একই ধরন বা প্যাটার্ন দেখা যায়। সেই বার্তার পর একটি লিংক পাঠানো হয়, যা ক্লিক করলে তার ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট খোলে। প্রোফাইলেও একটি নাম দেখা যায়। সেখানে যোগাযোগ করলে শুরুতে ‘১’ লিখে পাঠিয়ে বিনিয়োগ পরিষেবা চালু করতে বলা হয়। এরপর এএনএমব্র্যাকবিএক্সটি ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটের লিংক পাঠানো হয়। তাতে ব্রোকারেজ হাউসের নাম ও লোগো ব্যবহার করে ‘হাই নেট ওর্থ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট’ খোলার অপশন আসে এবং নিবন্ধন করতে বলা হয়। নিবন্ধন শেষে ব্যাংক ও ওয়ালেটে টাকা জমার অপশন আসে। এই পর্যায়ে ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা জমা দিতে হয়। নিবন্ধনের পর কেওয়াইসি (পরিচিতি তথ্য) সংযোজনের ধাপ আসে। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড (সিবিএল), ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজ, আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এমটিবি সিকিউরিটিজ, শেলটেক ব্রোকারেজ এবং ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নাম করে আলাদা আলাদা স্কিম চললেও তাদের টাকা তোলার ধরন এক। শুধু ব্রাক ইপিএল অ্যাপ এবং বাকিগুলোতে ওয়েবসাইট ব্যবহার হলেও দৃশ্যত সবটির ডিজাইন এবং গঠন এক। রূপালী বাংলাদেশ সব সিকিউরিজিট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছে, এই স্কিমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। 

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, এসব প্রতারণা স্কিমে জমার জন্য ব্যাংক এবং নগদ ও বিকাশের মতো এমএফএস চ্যানেল রয়েছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ‘চ্যানেল পাসওয়ার্ড’ দিতে হয়, যা কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি সরবরাহ করেন। তবে মোবাইল ওয়ালেটের ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ডের বাধা নেই। এখানে গ্রাহকদের দুটি নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে সরাসরি সেন্ড মানি করতে বলা হয়। টাকা পাঠিয়ে রেফারেন্স নম্বর শেয়ার করলেই অ্যাকাউন্ট সক্রিয় হয়ে যায়। অনেকেই সহজ পদ্ধতির কারণে এমএফএস বেছে নেন। এভাবে ব্যক্তিগত নম্বরকে টার্গেট করে প্রতারকেরা টাকা তুলছে, যা কোনো অনুমোদিত ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্টে না গিয়ে সরাসরি তাদের ব্যক্তিগত ওয়ালেটে চলে যাচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পাওয়া বিজ্ঞাপন দেখেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই না জেনে এসব প্রতারণামূলক স্কিমে ঢুকে পড়েন। তেমনি একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী আবিদ হোসেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আবিদ ফেসবুকের বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্দ হন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘বাজার বিশ্লেষণ’ নামে একটি ফেসবুক পেজ আমার নজর কাড়ে। পেজটির একটি বুস্ট করা স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘আমরা হাতেকলমে ৩টি স্টক বেছে নিয়েছি। যেগুলোর ১০ গুণ দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।’ পেজটিতে ঢুকতেই আমাকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করা হয়।

গ্রুপে গিয়ে দেখি, যেসব শেয়ার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এরমধ্যে একটি শেয়ার আমার কেনা আছে। লোকসানে থাকায় শেয়ারটি বিক্রি করে কীভাবে বের হবো সেই পথ খুঁজতেই তাদের দেওয়া লিঙ্কে প্রবেশ করে নিবন্ধন নিয়েছি। তাদের শর্ত মোতাবেক নিবন্ধন ফি দিয়েছি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। পরদিন দেখি ওই গ্রুপ থেকে আমাকে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। আবিদ হোসেনের মতো অন্তত ১৫ জন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলেছে রূপালী বাংলাদেশ। তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন একই ধরনের প্রতারিত হওয়ার গল্প। অর্থাৎ প্রতারণামূলক এসব স্কিমের প্রতিটি ধাপে আছে প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রযুক্তি প্লাটফর্মের দায়। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে নামসর্বস্ব অ্যাকাউন্ট দিয়ে শতন শত বিজ্ঞাপন চালিয়ে ব্যবহারকারীদের টেনে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

এই অনুসন্ধান চলাকালে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে থেকে যে চার দিন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন পেজ থেকে শুধু এক দিনেই ৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে। যে অর্ধশতাশিক পেজ থেকে বিজ্ঞাপনগুলো চালানো হয়েছে, সেগুলো এক বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয়, বিজ্ঞাপন চালানো ছাড়া তাদের প্রোফাইলে আর কোনো কার্যক্রম নেই, অ্যাডমিনদের বেশির ভাগের অবস্থান দেশের বাইরে। বিষয়টি জানতে পারার পর সিটি ব্রোকারেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএসইসি ও পুলিশকে জানানো হয়েছে। ব্র্যাক ইপিএল কর্তৃপক্ষ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। অন্যান্য ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসইসি থেকে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে।

কিন্তু সমাধান হয়নি। ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী আহসানুর রহমান বলেন, তাদের নাম ও লোগো দেখে অনেকে এসব গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন এবং বিশ্বাস করছেন। এতে বিনিয়োগকারীরা যেমন ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, তেমনি প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে। এ বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারকচক্র পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য লোভনীয় প্রস্তাব করে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উপরোক্ত ফেসবুক পেজ বা আইডি বা গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমরা ধাপে ধাপে এসব প্রতারণামূলক ফেসবুক পেজ বা আইডি বন্ধ করার চেষ্টা করছি। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!