জুলাই অভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতা হত্যার দায়ে শেখ হাসিনার ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া উচিত বলে মনে করে প্রসিকিউশন। তবে আইন অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের কাছে অন্তত একবার হলেও হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, সব অপরাধীর প্রাণ ভোমরা এবং সব অপরাধের নিউক্লিয়াস ছিল শেখ হাসিনা। এত ব্যাপক হামলায় ১৪০০ জন নিহত এবং ২৫০০০ আহত হয়েছেন। একজনের জন্য একবার মৃত্যুদ- হলে তার ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া দরকার।
এ মামলার দ্বিতীয় আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে প্রসিকিউশন। তবে মামলার তৃতীয় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে অপরাধের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করায় আইজিপি চৌধুরী মামুনের ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলেও জানান চিফ প্রসিকিউটর। এ ছাড়া আসামিদের সম্পদ উদ্ধার করে জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও করেন তিনি। চিফ প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, সেনাবাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল শেখ হাসিনা। জুলাই আন্দোলনে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে এক সপ্তাহ সময় আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল আগামী সোমবার থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নির্দেশ দেন।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
দিনের কার্যক্রমের শুরুতে কৌঁসুলি মো. মিজানুল ইসলাম এ মামলায় ৩ নম্বর অভিযোগের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। এ অভিযোগ ছিল রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার বিষয়ে। তার বক্তব্যে আবু সাইদকে গুলি করা কনস্টেবল আমির আলী ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্রের নাম আসে। এ সময় ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদকে গুলি করার সেই ভিডিওটি দেখানো হয়, যা গত বছরের ১৬ জুলাই এনটিভিতে লাইভ প্রচার করা হয়েছিল।
মিজানুল ইসলাম বলেন, আবু সাঈদকে হত্যা করার সময় হাতে লাঠি ছাড়া কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ছিল না। তার লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বারবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রহণ না করে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে বলা হয়েছিল যেন গুলিতে মৃত্যুর কথা না লিখে মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যুর করা লেখা হয়। কিন্তু ওই চিকিৎসক তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে একপর্যায়ে বিদেশে চলে যেতে প্রলুব্ধ করেন সরকারি দলের লোকজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই চিকিৎসক লেখেন, ‘মাথায় আঘাতে মৃত্যু হয়েছে’। তবে আদালতকে অবস্থানগত সাক্ষ্য বিবেচনা করার কথা বলেন।
আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ কমান্ড তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। তার বাসায় কোর কমিটির বৈঠক হতো। তিনি আইজপিকে নির্দেশ দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে এক পুলিশ কর্মকর্তার ভিডিও দেখেছেন তিনি, যেখানে ওই কর্মকর্তা বলেন- ‘স্যার গুলি করি একটা, একজন চলে যায়, বাকিরা যায় না’। তাজুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। তিনি যেহেতু নির্দেশ দিয়েছিলেন তাই তিনি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থার চেষ্টাও করেননি। তাই তিনি বলতে পারেন না যে, তিনি জানতেন না। এরপর প্রধান কৌঁসুলি জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ ও ৫০ ধারা এবং রোম স্ট্যাটিউটের ২৫(৩) অনুচ্ছেদে তুলে ধরেন। জেনেভা কনভেশনের ৮৭ ধারায় আদেশকারীর দায়িত্বের কথা বলা হয় এবং তা তিনি পড়ে শোনান।
তিনি যুক্তিতর্কে বলেন, রাষ্ট্রের পুরো ফোর্সকে তিনি (শেখ হাসিনা) ব্যবহার করেছেন। বিজিবি, পুলিশ, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা, শুধু সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেননি। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী নির্বিচার হাত্যাকা-ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণ তাদের ফুল দিয়েছে, চুমু খেয়েছে। শুধু কোটা আন্দোলন দমন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের এ নৃশংসতার উদ্দেশ্য ছিল, হাসিনাকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। তাই তারা নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করেছে। হাসিনার এসব কাজে চরম জিঘাংসা ফুটে উঠেছে।