থুথু ফেলা নিয়ে সাভারের আশুলিয়ার খাগান এলাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো খাগান এলাকা। সংঘর্ষে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। গত রোববার রাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সিটি ইউনিভার্সিটির। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০-২৫ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান। ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিটি ইউনিভার্সিটির পাশে থেকে ক্ষতিপূরণে তারা সহযোগিতা করবে। এদিকে দীর্ঘসময় ধরে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো প্রকার সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। এদিকে এ ঘটনার পর আজ মঙ্গলবার থেকে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটির সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলার সময় শিক্ষার্থীদের হাতে আটক হওয়া ১১ শিক্ষার্থীকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে সিটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত রোববার সন্ধ্যায় খাগান এলাকার ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস’ নামের একটি ছাত্র হোস্টেলের সামনে সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী মোটরসাইকেল থেকে থুথু ফেললে তা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। এ নিয়ে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী দেশীয় অস্ত্র ও ইটপাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ওই বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে গেলে ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন।
একপর্যায়ে রাত ১২টার পর ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের অবরুদ্ধ করে প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন ভবন ভাঙচুর করে। ভোররাতে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ফোটানো হয় ককটেল। এতে উভয় পক্ষের অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
গতকাল সোমবার সকালে সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে প্রবেশের ফটকেই দেখা যায় আগুনে পোড়ার দৃশ্য। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাচ, কাঠসহ ভাঙা বিভিন্ন জিনিসপত্র। ভেঙে দেওয়া হয়েছে একটি প্রাইভেটকার, দুটি মাইক্রোবাস, দুটি মোটরসাইকেল। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অন্তত তিনটি বাস, পাঁচটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকারে। এর মধ্যে কোনোটিতে সকালেও ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। অ্যাকাডেমিক ভবনেও চালানো হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। পুরো ভবনের জানালার থাই গ্লাস ভাঙা দেখা যায়, কোনোটি সম্পূর্ণ ভাঙা হয়েছে, কোনোটি আংশিক ভাঙা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় ফাইলের কাগজপত্র, ভাঙা কাচ ও ভাঙা আসবাবপত্র।
সেখানে প্রায় প্রতিটি কক্ষের চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, বাথরুমের কমোড, বেসিন, দরজা, এসি, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টার, অফিসকক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ ও কর্মকর্তাদের ডেস্কগুলো সম্পূর্ণ ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চালানো হয়েছে ব্যাপক লুটপাট। ল্যাপটপ, টাকাসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ড্যাফোডিলের এক ছাত্রের গায়ে থুথু লাগা থেকে ঘটনার শুরু। পরবর্তী সময়ে ওই ছাত্র সরিও বলেছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে সেভাবে নেয়নি, তাকে সেখানে মারধর করে। এরপর তাকে আটকে রাখে। যখন বিষয়টা আমাদের কাছে এসেছে, তখন আমরা এগোই। এভাবেই শুরু হয়। আমরা ঢিল ছুড়ছি, এ পর্যন্তই ছিল। কিন্তু পরে তারা, আমাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে গেলে দেখবেন, অ্যাকাউন্টসে কোনো টাকা নেই, পাঁচটি গাড়ি ভেঙেছে। প্রত্যেকটা রুমে রুমে সব ভাঙছে। কিছুই নেই। এগুলো কী ধরনের আচরণ। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কীভাবে পারে।’
সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, রাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। ওরা এসে পুরো ক্যাম্পাসে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শত শত ছাত্রকে মেরেছে, আহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাইনি।
ড্যাফোডিলের আটক ১১ শিক্ষার্থীকে হস্তান্তর :
ঘটনার রাতেই সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে ১১ জন ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীকে আটকে রাখে শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে তাদের ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ জানান, তাদের প্রশাসনের কিছু লোকজন এসেছিলেন, তাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ছাত্রদের ছেড়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো তাদের পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছে। এ ছাড়াও ছেড়ে দেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমাদের ভিসি শিক্ষার্থীদের সেখানে ভাংচুর করতে পাঠিয়েছে এমন জবানবন্দিও রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মূলত ইউজিসি তাদের মুক্ত করেছে। ইউজিসির প্রতিনিধিদলের কাছে শিক্ষার্থীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম, শিক্ষকরাও ছিল। এখন ওই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের এখন আমরা হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতি :
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের হামলায় অন্তত ২০-২৫ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান। গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, হামলাকারী শিক্ষার্থীরা আমাদের সীমানা প্রাচীর ভাংচুর করেছে। এ ছাড়া ১৩টির মতো গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের অফিস রুমে প্রবেশ করে ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রারসহ অফিসের সব কম্পিউটার ভাংচুর করে। গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লুট করেছে। রাত সাড়ে ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে এসে হতভম্ব হয়ে যাই। শিক্ষার্থীদের দ্বারা এমন কাজ কীভাবে সম্ভব। এরপর ড্যাফোডিলের উপাচার্যকে বিষয়টি জানিয়ে একজন প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।
তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও তারা কোনো সহযোগিতা করেনি। হামলায় আমাদের ২৫-২৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আরও প্রায় শতাধিক আহত হয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ করেনি। যাদের ধরা হয়েছে তারা যখন ভাংচুর চালাচ্ছিল তখন তাদের ধরা হয়েছে। তারা শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষার্থী কি ল্যাপটপ, কম্পিউটার, এসি এগুলো কি চুরি করতে পারে? আমরা চাই ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে। নাহলে আইনের আশ্রয় নেব।
তবে দায় শনাক্তে হামলার ফুটেজ চায় ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ। বিশ^বিদ্যালয়টির এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, আসলে ঘটনায় সঠিকভাবে কার দায়, কারা দায়ি সেগুলো বের করতে সময় লাগবে। এক্ষেত্রে সিটি ইউনিভার্সিটির কো অপারেশন লাগবে। তারা যদি আমাদের ফুটেজ দেয়, আমরা শনাক্ত করতে পারি, কোন শিক্ষার্থীরা কি করল, কারা করল আমরা বুঝতে পারব।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস.) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঝগড়াবিবাদ, ভাঙচুর যা হয়েছে রাতেই হয়ে গেছে। আর এ ঘটনা কেন ঘটল, সেটি আসলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পরিবেশ কিছুটা থমথমে।

