- ২০২১ সালের ৩ মার্চ থেকে গত বছরের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন দুদকের দায়িত্বে
- বেনজীরের সম্পদের পাহারাদার হিসেবে পরিচিত সাবেক দুদক চেয়ারম্যান এখনো ধঁরাছোয়ার বাইরে
- অভিযোগ থাকলেও বেনজীরের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেননি মঈনউদ্দিন
- দুর্নীতিবাজদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ
- তার অধীনে দুই কমিশনার ফাঁসলেও আঁচড়ও লাগেনি তার গায়ে
- সরকারঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি তদন্তে অনীহা ছিল মঈনউদ্দিন কমিশনের
- মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহর সময়ে চালু হয় দায়মুক্তির সংস্কৃতি
- মেগা প্রকল্প থেকে মাসোয়ারা নিতেন বলেও রয়েছে অভিযোগ
- অবৈধভাবে হাতিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। হয়েছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট-প্লটের মালিক
- কৃতকর্ম নিয়ে নেই অনুশোচনা। উল্টো সব অভিযোগ অস্বীকার মঈনউদ্দিনের
দায়িত্বে থাকাকালে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের রক্ষক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহ। বিভিন্ন সময় নামকাওয়াস্তে বেনজীরের বিভিন্ন স্থাপনায় অভিযান চালালেও কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেননি তিনি। বেনজীরের রূপগঞ্জের আনন্দ হাউজিংয়ে থাকা প্রায় ২৪ কাঠার ডুপ্লেক্স বাড়িতে তল্লাশির নামে করেছেন তামাশা। তার মালিকানাধীন সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কও রাখেন নিজের দখলে। অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেশ ছেড়ে পালাতেও সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এই মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে। শুধু বেনজীরের সম্পদের পাহারা দিয়ে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। রাজধানীর উত্তরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিনেছেন একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট।
অবৈধ সম্পদ উপার্জনের অভিযোগে তার অধীন অন্য দুই কমিশনারের বিরুদ্ধে বর্তমান কমিশন অভিযান পরিচালনা করলেও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ, গণঅভ্যুত্থানে পলাতক শেখ হাসিনা পরিবারের কোনো দুর্নীতিই কখনো নজরে আনেননি তিনি। বরং নিয়েছেন পতিত সরকারের কাছ থেকে নানান সুবিধা। সততার মুখোশধারী দুর্নীতিবাজ ও শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এখনো নিরাপদেই আছেন। শুধু নিরাপদেই নয়, দেশের ভেতরে থেকে শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন বলেও জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যরা কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তখনই। দুদক চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় মঈনউদ্দীন সব অভিযোগ ও মামলার তদন্ত শুরু করতেন খোদ শেখ হাসিনার নির্দেশে। যেসব বড় ব্যবসায়ী ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এবং মামলার তদন্ত শুরু করেছিলেন, সেসবের প্রমাণ না থাকলেও তাদেরকে হতে হয়েছে হেনস্তার শিকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক ব্যবসায়ী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার গার্মেন্টস এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। মাসে ব্যাংকে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার প্রতিপক্ষ কোনো একজনের সামান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমাকে বারবার হাজিরা দেওয়াসহ আমার প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঘুষ দিতে চাইলে চেয়ারম্যান সম্মতি জানিয়েছেন বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা। ওই ঘুষের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে আমার এখন কোম্পানি চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
বেনজীরের দোসর হিসেবে যত অপকর্ম
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীরের গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট পরিদর্শনে ২০২৪ সালের ৮ জুলাই অভিযান চালায় দুদক টিম। গুলশানের ১২৬ নম্বর সড়কের র্যাংকন আইকন টাওয়ারের চারটি ফ্ল্যাট পরিদর্শন করলেও মঈনউদ্দিনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এসব ফ্ল্যাট ক্রোক করা হয়নি বলেই রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযান পরিচালনাকারী তৎকালীন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিদর্শন করলে কি হবে, চেয়ারম্যানের কঠোর নির্দেশনা ছিল যেন এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা হয়। কিন্তু আদালত যেহেতু আমাদের রিসিভার নিয়োগ দিয়েছেন তার ধারাবাহিকতায় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমি, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা চেয়ারম্যানের নির্দেশনার বাইরে কিছু করতে পারিনি।’ র্যাংকন আইকন টাওয়ারের এই চারটি ফ্ল্যাটের তিনটি সাভান্না ইকো রিসোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে কেনা হয়। অপর ফ্ল্যাটটি বেনজীর আহমেদের ছোট মেয়ের হয়ে তিনি নিজের নামে কেনেন। এসব সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশনাও মানেননি সাবেক দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহ।
বেনজীরকে বিদেশে পালাতেও করেছেন সহযোগিতা
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগেই বেনজীর আহমেদ সপরিবারে বিদেশে চলে যান। এখনো ফেরেননি দেশে। ওই বছরের ৬ জুন স্ত্রী জীশান মীর্জা ও দুই মেয়েকে ৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয় দুদকে। এ ছাড়াও একই মাসের ২৩ ও ২৪ জুনও তলব করা হয় তাদের। কিন্তু বেনজীর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ আয়ের অভিযোগ থাকলেও তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেননি মঈনউদ্দিন। ফলে সহজেই দেশ ছেড়ে অঢেল সম্পদের মালিক বেনজীর এখন বিদেশে কাটাচ্ছেন আয়েশি জীবন।
করেছেন শুধুই ফরমায়েশি অভিযোগের তদন্ত
সরকারঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি তদন্তে অনীহা ছিল মঈনউদ্দিন কমিশনের। তার প্রত্যক্ষ ইশারায় সরকার বিব্রত হয় এমন কোনো কাজ করতে রাজি ছিল না দুদক। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের কাছে নিয়মিত বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানের চাল চুরি, গম চুরিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসত। তবে এসব অভিযোগ তদন্তের অনুমতি মিলত না। যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক) দিয়ে আটকে রাখা হতো। এর কারণ হিসেবে কমিশন বলত, এসব অভিযোগ অনুসন্ধান হলে সরকারের জনপ্রিয়তা কমবে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতিও অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া হতো না। ডিসি, ইউএনওদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অনেক অভিযোগ আসত। এক্ষেত্রে বলা হতো, এসব দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হবে। ফলে টিআইবির গ্লোবাল র্যাঙ্কিংয়ে দুর্নীতির তালিকায় বাংলাদেশে প্রথম দিকে চলে আসতে পারে। ফলে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়েছে কিন্তু সরকার চাচ্ছে না এমন হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিলেও অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কোয়ারি দিয়ে ফাইল ফেরত পাঠানো হতো। এভাবে এক একটা ফাইল ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত আটকে রাখা হতো।’ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘‘বর্তমানে তদন্ত শুরু হওয়া চিঠিতে লেখা থাকে ‘গোয়েন্দা সূত্রে’। এর মানে হলো এই ফাইল গোয়েন্দায় আগে থেকেই জমা ছিল। কোনো অভিযোগ এসেছে কিন্তু কমিশন চাচ্ছে না তদন্ত হোকÑ এমন হলে সেই ফাইল গোয়েন্দা শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। তদন্তের নামে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হতো।’’
ভুক্তভোগী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মঈনউদ্দিনের সময় যত মামলা হয়েছিল তার বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা। যে কারণে বর্তমান সময়ে এসে এসব ভুয়া মামলা শেষ করতে এখন হিমশিম খাচ্ছে দুদক। পট পরিবর্তনের পরও প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না সংস্থাটি। তৎকালীন সময়ে কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি, নেতাসহ সরকার ঘনিষ্ঠ আমলাদের জড়িত থাকার দালিলিক প্রমাণ পায় দুদক। এরপর সেই দুর্নীতিবাজদের তথ্য ধামাচাপা দেন দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। দুদক সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণে সুবিধাভোগী সিন্ডিকেটের হোতা সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। কক্সবাজার দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের অভিযানে দালাল ও সরকারি কর্মকর্তারা একের পর এক ধরা পড়েন। এতে ওই সিন্ডিকেটের অনিয়মে বাধা পড়ে। এরপরই তারা শরীফ উদ্দিনকে দমানোর ষড়যন্ত্র করেন। এক পর্যায়ে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হককে হেলালুদ্দীনের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা দেন। এর বিনিময়ে শরীফ উদ্দিনকে কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, শরীফকে অপসারণ করতে ৫০ কোটিরও বেশি টাকা দেওয়া হয় সেই কমিশনকে। এরপরই দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের অপসারণের আদেশে ৩ ও ৫ নম্বর অনুলিপিতে জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে দেওয়া হয়। শরীফকে অপসারণের পর ভূমি অধিগ্রহণের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধানটি ধামাচাপা পড়ে আছে গত ৫ বছর ধরে। দুদক কর্মকর্তারা জানান, শরীফ উদ্দিন রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলায় কক্সবাজারের চারজন জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর তাদের ভাগ-বাঁটোয়ারায় বড় ধরনের আঘাত লাগে। তখন থেকেই কক্সবাজারের স্থানীয় সিন্ডিকেটের লোকজন হেলালের মাধ্যমে দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। তবে দুদক থেকে শরীফকে অপসারণের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নতুন কোনো মামলা, গ্রেপ্তার কিংবা চার্জশিট দেওয়া হয়নি। সবই করা হয়েছিল তৎকালীন কমিশনের নির্দেশে।
মেগা প্রকল্প থেকে নিতেন মাসোহারা
অভিযোগ রয়েছে, মঈনউদ্দিন কমিশন দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের অনিয়ম ঢাকতে নিতেন নিয়মিত মাসোহারা। বিশেষ করে, কক্সবাজারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প থেকে। চট্টগ্রামের কেজিডিসিএলের গ্যাস কানেকশন জালিয়াতির মামলায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলেকে গ্রেপ্তার করতে দুদক থেকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। দুদক কর্মকর্তা শরীফ মামলাটি করলেও কমিশন পরে তার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু আদালত সেই প্রতিবেদন গ্রহণ না করে শরীফের এফআইআরকে কগনিজেন্স (আদালতের বিচারিক ক্ষমতা) হিসেবে আমলে নেন। তখনই প্রমাণিত হয়- শরীফের তদন্ত সঠিক ছিল। মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কমিশন পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে এফআইআরটি দিয়েছিল। পরে তারাই নি¤œ আদালতের কগনিজেন্সের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন, যা এখনো স্থগিত রয়েছে।
ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদেরও দিয়েছেন সুবিধা
২০১৯ সালে ক্যাসিনো সম্রাটসহ একশজনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। সেই সময় সংস্থাটির সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মকর্তা নিয়োগের তথ্য জানান। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। অভিযানের প্রথম দিনেই অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাসিনো ও জুয়াবিরোধী অভিযানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে দুদকে একাধিক অভিযোগ আসলেও কোনো তদন্তই করেনি সংস্থাটি। ২০২১ সালের ৩ মার্চ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব এই মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরই তিনি ক্যাসিনো সংক্রান্ত অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান থামিয়ে দেন। ওই অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, কমিশনার মোজাম্মেল হক খান এবং জহুরুল হককে বিপুল পরিমাণ টাকা দেন ক্যাসিনো থেকে সুবিধা পাওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও মন্ত্রীরা। এর বিনিময়ে তৎকালীন কমিশন সেই অনুসন্ধান থামিয়ে দেয়।
চালু করেন দায়মুক্তির সংস্কৃতি
ক্লিনচিট বা দায়মুক্তির সংস্কৃতিও চালু হয় মঈনউদ্দিনের আমলেই। দুদক থেকে একাধিকবার ক্লিনচিট বা দায়মুক্তি পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধেই পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। যার মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ছিল ছাগলকা-ে আলোচিত এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমান। দুদকে চারবার দায়মুক্তি পেয়েছিলেন মতিউর। এ ছাড়া জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা দীলিপ কুমার আগরওয়ালাও দুর্নীতির অভিযোগে দুবার দায়মুক্তি পেয়েছেন। দীলিপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিদেশে শোরুমের তথ্য থাকলেও দুদক তা খুঁজে পায়নি। সন্দ্বীপের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও দুদক কোনো দুর্নীতির খোঁজ পায়নি। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দেড় বছরে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন আট সংসদ সদস্য। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু দুই দফা ক্লিনচিট পেয়েছেন। জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, শেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক ও সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও বিএম মোজাম্মেল হক দুদক থেকে দায়মুক্তি পান তার আমলে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা এবং দলটির ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এ করা সব মামলায় দায়মুক্তি দেওয়া হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে গুলশানের একটি বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক; কিন্তু সেই মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয় প্রধান অভিযুক্ত সাবেক সংসদ সদস্য সালাম মুর্শিদীকে। এ জন্য তার কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ন্যক্কারজনক বিদায়
তৎকালীন সরকারের আজ্ঞাবহ সেই দুদক ক্ষমতার পালাবদলের পরেই পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ভোল পাল্টালেও শেষ রক্ষা হয়নি। ৫ আগস্টের পর আড়াই মাসে দুই শতাধিক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় এই দুই মুখো চেয়ারম্যান। তার সময়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধেই দায়ের করা হয় পাঁচটি মামলা। তবে রকেট গতিতে অনুসন্ধান শুরু হলেও মানা হয়নি দুর্নীতি তদন্তে দুদকেরই নীতিমালা। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ছিল খোদ দুদকের ভেতরেই। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা তখন বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর কমিশন তাদের গদি বাঁচাতে ভোল পাল্টে ত্রুটিপূর্ণ তৎপরতা শুরু করেছিল। এর একটিই কারণ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি। ওই বছরেরই গত বছরের ২৯ অক্টোবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দুই কমিশনারসহ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশন।
সব অভিযোগ অস্বীকার, উল্টো উষ্মা প্রকাশ
নখদন্তহীন এই বাঘ ক্ষমতার পালাবদলে পদত্যাগে বাধ্য হলেও একফোঁটা নেই অনুশোচনা। নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন রূপালী বাংলাদেশের কাছে। বেনজীরকে বিদেশ যেতে তখন কেন কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখন প্রয়োজন পড়েনি তাই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।’ তাহলে কি আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে বেনজীরকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন তা সত্যিÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে রাগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। আপনি নিজে খোঁজ নেন।’ তৎকালীন সরকারের যেসব ঊর্ধ্বতনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো আপনার সময় পাননি জানতে চাইলে, ‘না’ বলে ফোন কেটে দেন।

