ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। গত সোমবার ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। বাকি ৬৩টি আসনের মধ্যে ২৩টি দলের ও ৪০টি আসন বিগত দিনে আন্দোলনের সহযোগী দলগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে সমঝোতা হলে আসন বণ্টনের হিসাব কিছুটা পাল্টে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
তালিকা ঘোষণার সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ‘প্রার্থী ঘোষিত আসনেও পরিবর্তন আসতে পারে।’ তবে নির্বাচন ‘হওয়া-না হওয়া’ নিয়ে যেখানে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে, সেখানে তপশিলের আগেই প্রার্থী ঘোষণার কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো মনোনয়নকেন্দ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, অন্তত চারটি কারণে প্রার্থীদের একক তালিকা প্রকাশ করেছে বিএনপি। এমনকি সম্ভাব্য আরও একজন করে প্রায় প্রতিটি আসনেই বিকল্প রয়েছে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার বেশ আগে এই তালিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাকে সুযোগ দেওয়া; একাধিক প্রার্থী নিয়ে আসনগুলোর বিভ্রান্তি-বিড়ম্বনা এড়ানো। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর বিছিন্নভাবে দেশের কয়েকটি জায়গায় মনোনয়নবঞ্চিতদের পক্ষে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ হয়েছে, মনোনয়নবঞ্চিতদের কষ্টও রয়েছে, তারপরও বড় ধরনের কোনো ক্ষোভ দেখা যায়নি।
বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হওয়া ত্যাগী নেতারা মূল্যায়িত হবেনÑ এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর অনেক ত্যাগী নেতা মনোনয়ন পাননি বলে সামাজিক মাধ্যমে হাহাকার দেখা গেছে। যদিও সেই সব ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। যারা মনোনয়ন পাননি, তারা কষ্ট পেলেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মনোনয়নপ্রাত্যাশী জানান, দল যাকে যোগ্য মনে করেছে, তাকেই দিয়েছে। বিএনপির প্রতীক একটাইÑ ধানের শীষ। বিএনপি দলীয় মনোনয়ন দিলেও হাপিত্যেশ ছিল কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
বিএনপির দায়িত্বশীল ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, চারটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, মনোনীতরা যেন এই সময়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং কমিয়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, দল থেকে সম্ভাব্য বিকল্প প্রার্থী কী করেন; তার আচরণ কী; তার সাংগঠনিক অবস্থান কেমন, তা দেখা হবে। সংশ্লিষ্ট আগ্রহী কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটিও খেয়ালে রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মনোনীত প্রার্থীর ত্রুটি ধরা পড়লে চূড়ান্ত মনোনয়নে দ্বিতীয় বিকল্প সামনে আসতে পারেন। তা ছাড়া মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রার্থীর মনোভাবে লক্ষ রাখবে দল। বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়ালে ছিটকে পড়তে পারেন চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা থেকে। আরেকটি কারণ হিসেবে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, সরকারকে নির্বাচনের দিকে ঠেলে দিতে বিএনপির কৌশলের অংশ হিসেবেও দ্রুত প্রার্থী ঘোষণা। নির্বাচন থেকে যেন সরকার পিছপা না হয়, সব দলই যেন নির্বাচনমুখী থাকে, সেদিক বিবেচনা করে প্রার্থীর তালিকা আগেই জানিয়েছে বিএনপি। তা ছাড়া যারা বলছে বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তাদের জন্য এটা জবাবÑ বলছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিন ধাপের যাচাই-বাছাই ও জরিপের ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় প্রথমে সারা দেশের ৩০০ আসনে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক অবস্থান ও নির্বাচনি সক্ষমতা যাচাইয়ে তিন দফা জরিপ পরিচালনা করা হয়। এরপর ওই জরিপের ফলাফল পর্যালোচনা করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির তিন নেতাÑ নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। এই পাঁচ নেতা প্রায় এক মাস ধরে দলীয় পর্যায়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে একাধিক ভার্চুয়াল বৈঠক ও সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে একটি প্রাথমিক খসড়া তালিকা তৈরি করেন।
জরিপের ফলাফল ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য যাচাইয়ের পর ২৬০টি আসনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। গত সোমবার দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই তালিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনার পর ২৩৭টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করা হয়। ২৩টি আসন নিয়ে বৈঠকে ঐকমত্য না হওয়ায় তা স্থগিত রাখা হয়। প্রার্থী ঘোষণার এক দিন পর মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনে দলীয় প্রার্থী কামাল জামান মোল্লার প্রার্থিতা স্থগিত করেছে বিএনপি। অনিবার্য কারণে ওই আসনে তার প্রার্থিতা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি দলটির পক্ষ থেকে। যদিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বক্তব্য শেষে জয় বাংলা বলে তাকে জিহ্বায় কামড় দিতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির এক সমস্য রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সম্ভাব্য প্রার্থীদের ২৬০টি আসনের একটি তালিকা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়। সেখানে ২৩৭টি আসনের প্রার্থী নিয়ে ঐকমত্য হয়। বাকি ২৩টি আসন নিয়ে ঐকমত্য হয়নি বোর্ডে। তিনি বলেন, ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা থেকে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে দলীয় কোন্দল কমানোর বদলে বাড়ালে, বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়ালে ঝুঁকিতে পড়বেন সেই প্রার্থী।
দলীয় নেতাদের মতে, বিএনপি এবার প্রার্থী বাছাইয়ে অতীতের তুলনায় বেশি গবেষণাভিত্তিক ও সংগঠিত পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, যাতে মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় নেতাদের অগ্রাধিকার দিয়ে শক্তিশালী নির্বাচনি দল গঠন সম্ভব হয়। তবে যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের হতাশ হতে নিষেধ করেছে কেন্দ্র। মনোনয়নপ্রাত্যাশীদের সঙ্গে এ কারণেই দফায় দফায় বৈঠক করেছে বিএনপির কেন্দ্র। সরাসরি কথা বলেছেন দলটির ভারপাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যারা এমপি হওয়ার টিকিট পাবেন না, তাদের জন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সুযোগ রাখছে। কাউকে হতাশ করেবে না বিএনপি, তবে এক পরিবারে একাধিক বড় সুবিধা দেবে না বলেও জানিয়েছে। তার প্রতিফলন দেখা গেছে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
বিএনপি ঘোষিত প্রার্থীর তালিকা দেখে অনেক নেতাই খুশি, কেউ কেউ মনঃক্ষুণœ । অনেকে তাদের প্রত্যাশামাফিক আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা দেখে বিচলিতও। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, যুগপৎ আন্দোলনে যুক্তদের নিয়ে বিএনপি সর্বোচ্চ ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। এমনকি ভোটের পর সরকার গঠনেও সব দলকে যুক্ত করার পক্ষে শীর্ষ নেতৃত্ব। জাতীয় সরকার গঠনেরও পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছি। তবে দলের ভাবমুর্তি ক্ষুণœ করলে দল নিশ্চই পুনর্বিবেচনা করবে।’ তা ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে যারা যারা যুক্ত ছিলেন, দল-জোট আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করব। যারা মনোনয়ন পাননি, তারা যাতে মনে না করেন এটাই একমাত্র পদ। বিএনপি বড় দল, কাউকে হতাশ করবে না দল।’

