ঢাকা বুধবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫

ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা নয়

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:১০ এএম

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ ও স্থায়ী জনস্বাস্থ্য সংকটে। নভেম্বরের শুরুতেই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যু এবং নতুন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এই সংখ্যা কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের প্রস্তুতির অভাব ও অবহেলার নির্মম প্রতিফলন। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮ জনে, আর আক্রান্তের সংখ্যা ৭২ হাজার ৮২২ জন। এটি কেবল স্বাস্থ্য খাতের জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্য এক অশনিসংকেত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজব্যবস্থা, এবং প্রশাসনের দুর্বল পদক্ষেপ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণ। ঢাকার রাস্তাঘাটে, নির্মাণাধীন ভবনে, বাড়ির ছাদে কিংবা ফুলের টবের পানি এসবই মুলত এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র। যেখানেই পানি জমে, সেখানেই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তবুও অধিকাংশ সিটি করপোরেশন এখনো কার্যকর কোনো স্থায়ী পরিকল্পনা নিতে পারেনি। মশা নিধন কার্যক্রম চলছে এলোমেলোভাবে, কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ ছাড়াই। স্থানীয় জনগণও সচেতন নয়, যার ফলে প্রশাসনের সামান্য উদ্যোগও বিফল হচ্ছে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকতে পারে। অর্থাৎ, শীতেও এডিস মশা সক্রিয় থাকবে। এর অর্থ, আমরা যদি এখনই কঠোর ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নিই, তাহলে এই সংকট আগামী বছরগুলোতেও আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই চাপের মুখে। চিকিৎসক ও নার্সদের পরিশ্রমের পরও শয্যার সংকট, রক্তের অভাব এবং পর্যাপ্ত ওষুধের ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা বিলম্বে হাসপাতালে পৌঁছানোর কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগেও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অর্থাৎ, ডেঙ্গু আর কেবল নগরজীবনের সমস্যা নয়; এটি এখন সারাদেশব্যাপী জনস্বাস্থ্য সংকট।

প্রশাসনের ব্যর্থতার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের উদাসীনতা ও পরিস্থিতিকে জটিল করছে। অনেকেই জানেন যে, জমে থাকা পানি এডিস মশার জন্মস্থান, তবুও নিয়মিত পরিষ্কার করেন না। বাড়ির বারান্দা, ছাদ, ফুলের টব কিংবা ভাঙা পাত্রে জমে থাকা পানি এক সপ্তাহের মধ্যে মশার ঘর হয়ে ওঠে। আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রথম দায়িত্ব নাগরিকের।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, বাজার ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে। শুধু ফগিং নয়, লার্ভা ধ্বংসকারী ওষুধের ব্যবহার ও গবেষণার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ও টেকসই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মশা নিধন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অবহেলা প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পর্যাপ্ত চিকিৎসক, ওষুধ, পরীক্ষা ও রক্তব্যাংকের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

এখন সময় এসেছে প্রচলিত কর্মসূচির বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। শুধু মশা মারা নয়, শহর পরিকল্পনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসন ও জনসচেতনতা বাড়ানো। সবকিছু মিলিয়ে সমন্বিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। স্কুলে, অফিসে, বাজারে প্রত্যেকে যেন নিজের আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে, সে দায়িত্ববোধও জাগাতে হবে।

আমরা মনে করি, ডেঙ্গু কোনো আকস্মিক বিপর্যয় নয়। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলা, পরিকল্পনার ঘাটতি এবং দায়িত্বহীনতার ফল। প্রতি বছরই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। ডেঙ্গু মোকাবিলা কেবল সরকারের একার দায়িত্ব নয়। এই লড়াইয়ে প্রতিটি নাগরিককে শামিল হতে হবে। নাগরিক সচেতন হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটাই কমে আসবে।

প্রতিটি মৃত্যু আমাদের ব্যর্থতার সাক্ষী। আর তাই, ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা পরিহার করে বিজ্ঞানভিত্তিক, পরিকল্পিত ও জনসম্পৃক্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করার কোনো বিকল্প নেই।

আমরা আশা করব, সরকার বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।