ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট। গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সারা দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিলে কিছুটা ঢিমেতালে। এর মধ্যেই হঠাৎ দেশজুড়ে তীব্র কাঁপুনি। গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। তীব্র এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭; উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৫।
গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সময়ে মাত্র ২৬ সেকেন্ডের এই ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৪ জেলায় ১২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৪ জন, গাজীপুরে ১ জন, নারায়ণগঞ্জে ২ জন এবং নরসিংদীতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় সারা দেশে তিন শতাধিক মানুষ আহত এবং বেশ কয়েকটি ভবন ও স্থাপনায় ফাটল দেখা গেছে। এই ৪ জেলার বাইরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, মাদারীপুর, নীলফামারী, সীতাকু-, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, বগুড়া, বরিশাল ও মৌলভীবাজার থেকে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ আশপাশের এলাকায়ও ভূমিকম্প হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ভূমিকম্পে নরসিংদীর ঘোড়াশালের সাবস্টেশনসহ ৭টি বিদ্র্যৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ শেষে ৬টি কেন্দ্র ও সাবস্টেশন বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে।
গতকালের ভূমিকম্পে যে তীব্র ঝাঁকুনি হয়েছে, তাকে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে উল্লেখ করেছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘যে অঞ্চলে ভূমিকম্পটি হয়েছে, সেটি ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের অংশভুক্ত।’
এদিকে ভূমিকম্পের ঘটনায় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এক বার্তায় এই কথা জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার ফেরিফায়েড ফেসবুকে দুপুর ১টায় দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে যেসব ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। কোনো ধরনের গুজব বা বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে সরকার আগে থেকে সতর্ক থাকলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় শোক ও উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার পূর্ব থেকেই সতর্ক থাকলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটানোসহ মানুষকে সুরক্ষিত রাখা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হতো। বাংলাদেশের মানুষ নানা প্রাকৃতিক বিপৎসংকুল দুর্যোগ মোকাবিলা করে সব সময় সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আজকের (গতকাল) ভূমিকম্পেও বাংলাদেশের মানুষ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’ সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঘটনায় জরুরি নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
ভূমিকম্পের পরপরই ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনার জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি ‘নিয়ন্ত্রণকক্ষ’ বা কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে দুর্ঘটনাসম্পর্কিত যেকোনো তথ্য আদান-প্রদান ও জরুরি প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণকক্ষের নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের নম্বরগুলো হলোÑ মুঠোফোন নম্বর : ০১৭০০-৭১৬৬৭৮ ও ফোন নম্বর : ০২-৪১০৫১০৬৫।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পে হতাহতসহ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে নানা তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যে বলা হয়, রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে এএসআই জাকারিয়া হোসেন নিশ্চিত করেছেন, এখানে তিনজন মারা গেছেন। ১০ জন আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। আরো বলা হয়, ভূমিকম্পের সময় খিলগাঁওয়ে নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে পাশের দোতলা একটি ভবনে একটি ইট পড়ে একজন আহত হন।
তীব্র কাঁপুনিতে আতঙ্ক : কোনো কিছু বোঝার আগেই ভূমিকম্পের তীব্র কাঁপুনিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজধানীবাসী। সাধারণ মানুষকে ঘর বেরিয়ে সড়কে জড়ো হতে দেখা যায়। অনেকের বাসাবাড়ির আসবাবও ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী ফারজানা বলেন, ‘হঠাৎ করে সব কাঁপাকাঁপি শুরু হয় আর মনে হয় যেন হঠাৎ করে ঝমঝম শব্দে কিছু ভেঙে পড়ছে।’ এ সময় তার অফিসের একটি কক্ষের ফলস সিলিং খুলে পড়ে বলেও জানান তিনি। সাততলা ভবনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসার পর একজন সহকর্মীকে কান্নায় ভেঙে পড়তেও দেখেন বলে জানান মিস ন্যান্সি। ভূমিকম্পের সময় ঢাকার লালবাগের চুড়িহাট্টার বাসায় ছিলেন ইমরান খান। হঠাৎ করে বাড়িটি দুলতে শুরু করে বলে তিনি জানান। ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পেরে বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন তিনি। এ সময় এলাকার অন্য ভবনের বাসিন্দাদেরও রাস্তায় জড়ো হতে দেখা গেছে বলে জানান তিনি। পুরান ঢাকার স্বামীবাগের বাসিন্দা অরুণ সাহা জানান, প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে যখন দেখেন যে, শোকেসের কাচের জিনিসপত্র কাঁপছে, তখন বুঝতে পারেন ভূমিকম্প হচ্ছে। দ্রুত পরিবার নিয়ে তিনি রাস্তায় নেমে আসেন।
ঢাকা : ভূমিকম্পে পুরান ঢাকা ও মুগদায় ৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুরান ঢাকায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের নাম জানা গেছে। একজনের নাম রাফিউল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তবে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার সাজ্জাদ বলেছেন, তিনি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
মিটফোর্ড হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নিহত আরেকজনের নাম আবদুর রহিম (৪৮)। ১২ বছরের একটি শিশুর মরদেহ আনা হয়েছে। তার পরিচয় জানা যায়নি।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন বলেন, ভূমিকম্পের সময় পুরান ঢাকার কসাইটুলী এলাকার একটি ভবনের রেলিং ধসে পড়ে ৩ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
সরেজমিন সকালে দেখা যায়, কসাইটুলীতে ২২/সি কেপি গোজ স্ট্রিট গলিতে রক্ত পড়ে আছে। পাঁচতলা ভবনে ভেঙে পড়া রেলিং সরাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। রায়হান নামের এক স্থানীয় জানান, ভূমিকম্পের সময় সবাই ছোটাছুটি করছিল। পরে এখানে একজন শিশুসহ ৩ জন গুরুতর আহত হন। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সে সময় ফায়ার সার্ভিস ঢাকা সদর জোন-১ এর জোন কমান্ডার এনামুল হক জানান, ভবনের ভেতরে কেউ আটকে আছে কি না, তারা খোঁজ করছেন।
অন্যদিকে মুগদার মদিনাবাগে ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে মাথায় পড়ে মাকসুদ (৫০) নামের এক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সকাল পৌনে ১১টার দিকে মুগদা মদিনাবাগ মিয়াজি গলিতে ঘটনাটি ঘটে। দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুগদা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জানান, মাকসুদ মদিনাবাগ মিয়াজি গলির নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তাকর্মী। ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে বাইরে যাচ্ছিল সে। এ সময় ভবনের রেলিং ধসে তার মাথার ওপর পড়ে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এসআই আরও জানান, খবর পেয়ে দুপুরে মুগদা হাসপাতাল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহত মাকসুদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরসীতা গ্রামে।
নরসিংদী : নরসিংদীতে ভূমিকম্পে ৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলী গ্রামে ভবনের দেয়াল ধসে হাফেজ ওমর ফারুক নামে (৮) বছর বয়সি এক শিশু মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত ওই শিশুর বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বলও মারা গেছেন।
তথ্যটি নিশ্চিত করে নিহত ওমর ফারুকের চাচা জাকির হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ভয়াবহ ভূমিকম্পে আমার ভাই দেলোয়ার হোসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাড়ে ৫টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ভবনের দেয়াল ধসে ভাতিজা হাফেজ ওমর ফারুক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তা ছাড়া এতে ওনার দুই ভাতিজি গুরুতর আহত হয়ে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া নরসিংদীর শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামে ভূমিকম্পে সময় গাছ থেকে পড়ে ফোরকান (৩৫) নামে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান। অন্যদিকে ভূমিকম্পের সময় মাটির ঘরের দেয়াল চাপায় কাজম আলী (৭৫) নামে বৃদ্ধ মারা গেছে বলে জানা যায়। নিহত কাজম আলী নরসিংদীর পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন। এ ছাড়া ভূমিকম্পের সময় ধানখেত থেকে দৌড়ে বাড়ি ফেরার পথে গর্তে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করে মো. নাসির উদ্দীন (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ কৃষক মারা গেছেন। নিহত নাসির উদ্দীন উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) কাউছার আলম সরকার। এ নিয়ে নরসিংদীতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচজন হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে জেলা সিভিল সার্জেন্ট অফিস।
নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে ফাতেমা নামের এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নবজাতকের মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন বেগম আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মৃত ফাতেমা গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ইসলামবাগ ৫ নম্বর ক্যানেল এলাকার আব্দুল হকের মেয়ে।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে ভূমিকম্পের সময় ঘটনাস্থলে হয়ে ভুলতা গাউছিয়া যাওয়ার সময় সড়কের পাশের দেয়াল ধসে নবজাতক ফাতেমা, তার মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন বেগমের ওপর পড়ে। এ সময় ঘটনাস্থলেই নবজাতকের মৃত্যু হয়। পরে তারা দেয়ালের নিচ থেকে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেন। আহত অবস্থায় নবজাতকের মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন বেগমকে উদ্ধার করে স্থানীয় প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নবজাতকের মা ও প্রতিবেশী গুরুতর আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া ভূমিকম্পের সময় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের তারের সঙ্গে অন্য তারের ঘর্ষণে পাশের একটি তুলা কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। বন্দরের কুড়িপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে বন্দর ও সোনারগাঁ ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি স্থানীয়ভাবে ‘জুলহাস মিয়ার তুলা গাইট বাঁধার কারখানা’ নামে পরিচিত।
কারখানার মালিক জুলহাস মিয়া বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় শ্রমিকরা কাজ করছিলেন। হঠাৎ বৈদ্যুতিক খুঁটির দুই তার সংস্পর্শে এসে আগুনের ফুলকি পড়ে তুলার ওপর। মুহূর্তেই আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে যায়। অগ্নিকা-ে প্রায় কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।’ নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক ওসমান গনি বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করি। পাঁচটি ইউনিট তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে ধামগড় ফাঁড়ির পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
গাজীপুর: ভূমিকম্পের সময় গাজীপুরের কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে সুজিৎ দাস (৩৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। গাছ থেকে পড়ার পর তাকে উদ্ধার করে কালীগঞ্জ সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া শাদেরগাঁও জামে মসজিদের দুটি গম্বুজ কাত হয়ে গেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা গেছে। নবনির্মিত সাদেরগাঁও চারতলা বিশিষ্ট স্কুলে বেশ কয়েকটি ফাটল দেখা গেছে। এছাড়া গাজীপুরের টঙ্গী ও শ্রীপুরে কয়েকটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে শতাধিক পোশাক শ্রমিক আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারখানাটি ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষরা। ভূমিকম্পের মুহূর্তে উঁচু ভবন দুলতে শুরু করলে ঘরবাড়ি, অফিস, শিল্প-কারখানা, দোকানপাট থেকে মানুষ দ্রুত খোলা জায়গায় ছুটে আসে। এ সময় বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। ইটাহাটা এলাকায় স্থানীয় কোস্ট টু কোস্ট কারখানায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অন্তত কয়েকশ শ্রমিক আহত হন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ
টঙ্গী জরুরি বিভাগের ডা. ইশরাত জাহান এনি বলেন, ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। মাঠে ফায়ার সার্ভিসের টিম মাঠে রয়েছে এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা পুরোপুরি প্রস্তুত।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলম হোসেন বলেন, গাজীপুরে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। কিছু শ্রমিক হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের টিম বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পরিস্থিতি পর্যেবক্ষণ করছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হবে।
মাগুরা : মাগুরায় ভূমিকম্পের আতঙ্কে শ্রীপুর উপজেলার আমতৈল গ্রামে অবস্থিত স্টাইলস্মিথ স্যান অ্যাপারেলস লিমিটেড গার্মেন্টসে শতাধিক নারী-পুরুষ কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভূমিকম্প অনুভূত হলে হঠাৎ কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় কর্মরত শ্রমিকরা দ্রুত প্রাণরক্ষার্থে নিচে নেমে রাস্তায় জমায়েত হন। প্রথমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও কাজে ফিরে যাওয়ার পর ভয় ও আতঙ্কে অনেক শ্রমিকের মাথা ঘোরা, বমি ও অসুস্থতা দেখা দেয়। তাদের দ্রুত শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাসমুস সাকিব জানান, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া’র মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে কারো শরীরে বড় ধরনের আঘাত নেই।
গার্মেন্টসের প্রশাসনিক প্রধান মো. আমান উল্লাহ জানান, যখন ভূমিকম্প অনুভূত হয়, তখন কর্মীরা বাইরে চলে আসে। পরে তারা কাজে যোগদান করে। কিন্তু এর কিছু সময় পর আতঙ্কের কারণে অনেকে অসুস্থ পড়লে তাদের শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম নগরের মনসুরাবাদ এলাকায় একটি ৬ তলা ভবন পাঁচ বছর আগে ভূমিকম্পে কিছুটা হেলে পড়েছিল। গতকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ভবনটি আরও হেলে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও পুলিশের সদস্যরা ভবনটি পরিদর্শন করেছেন।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যরা ভবনটি দেখতে যান। ভবনটি নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায় পড়েছে। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ বলেন, ভূমিকম্পের পর ভবনটি আরও একটু হেলে পড়েছে। বিষয়টি দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। এ বিষয়ে তাদের জানানো হয়েছে।
রাবির হলে ফাটল : ভূমিকম্পে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শেরেবাংলা ফজলুল হক হলের দেয়ালে ফাটল এবং বিভিন্ন স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীরা দ্রুত স্থানান্তর ও হল পুনর্নির্মাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
গতকাল শুক্রবার ভূমিকম্পের পর বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা হলের প্রধান ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। পরে তারা মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। বিক্ষোভের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে শিক্ষার্থীরা সেখানে এক ঘণ্টার মতো অবস্থান করে বিক্ষোভ শেষ করেন।

