ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

অন্তর্বর্তী আমলেও বাড়ল খেলাপি ঋণ

রহিম শেখ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৫, ১১:৪২ পিএম
  • ২৫ বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ
  • এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা
  • মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশই খেলাপি
  • তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি
  • যেসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে
  • আগে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ি থাকার ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হতো
  • গত মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পার হওয়ার পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হচ্ছে
  • বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত অনেকে এখন জেলে বা পলাতক আছেন
  • রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে অনেক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালো যাচ্ছে না
  • ব্যাংকগুলোর প্রত্যাশিতভাবে ঋণ আদায় হচ্ছে না

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাতে সংস্কার ও নানা উদ্যোগের পরেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। মোটাদাগে লুকিয়ে রাখা খারাপ ঋণের আসল চিত্র সামনে আনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আদায় না করে এখন আর নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণের তথ্য যাচাই হচ্ছে। যে কারণে বেড়েই চলেছে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক। নতুন হিসাব বলছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা ২০০০ সালের পর সর্বোচ্চ। গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক শুধু আর্থিক খাতের দুর্বলতাকেই উন্মোচন করছে না, বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগও।

বিশ্লেষকদের মতে, বিগত সরকারের সময় নীতিসহায়তার আড়ালে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার সুযোগ দিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় ঋণগ্রহীতারা ঋণসীমা বাড়িয়ে কিংবা আরেক নামে ঋণ নিয়ে তা সমন্বয় করে অনাদায়ি ঋণ নিয়মিত দেখাত। তবে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ ধরনের সুযোগ বন্ধ হয়েছে। আগে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ি থাকার ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হতো। তবে গত মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পার হওয়ার পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হচ্ছে। এ ছাড়া বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত অনেকে এখন জেলে বা পলাতক আছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বিভিন্ন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রত্যাশিতভাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় হচ্ছে না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ এভাবে লাফিয়ে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কঠোরতার পাশাপাশি কোনো প্রকৃত ব্যবসায়ী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণ আদায় জোরদারে একদিকে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু নীতি সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে এখন খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণে বিশেষ এ সুবিধা মিলবে। আবার ঋণ অবলোপনের শর্ত শিথিল করে খেলাপি হওয়ার পরই তা আর্থিক বিবরণী থেকে আলাদা করে রাখার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। অবশ্য ঋণ অবলোপনের জন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। আবার ভুয়া বা অন্য নামে নেওয়া ঋণে শিথিল শর্তে পুনঃতপশিল করার সুযোগ নেই। যে কারণে এ উপায়ে নিয়মিত হচ্ছে খুব সামান্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ছিল ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে বিবেচনায় এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মানে এক বছরে খেলাপি বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আর গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মানে ৯ মাসে বেড়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিল ব্যবস্থা চালু হয়। এর পর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে কখনো ঋণ পরিশোধ না করেই নিয়মিত রাখা, নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতপশিল কিংবা ভুয়া ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হতো। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর গত বছরের আগস্টে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংক খাতের অনৈতিক চর্চার বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখিয়ে আসছেন। কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রেখে এবার লভ্যাংশ দিতে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী বছর কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি হলে যত মুনাফাই হোক, লভ্যাংশ দিতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে একবার দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের তথ্য প্রকাশ করে। সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বেড়ে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের যা ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২৩ সাল শেষে এ রকম ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এক বছরে খারাপ ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বা ৫২ শতাংশ। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পুনঃতপশিল করা অনাদায়ি ঋণ রয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। নিয়মিত খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবলোপন করা অনাদায়ি ঋণ স্থিতি বেড়ে ২০২৪ সাল শেষে ৬২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে। মূলত আগে পুনঃতপশিলসহ নানা উপায়ে নিয়মিত দেখানো ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খেলাপি, রাইট-অফ, পুনঃতপশিলকৃত ও ঋণ আদালতে আটকে থাকা ঋণসহ ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট’ শিগগির ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, গত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাপক অনিয়ম, প্রতারণা ও দুর্বল নজরদারির ফলেই খেলাপি ঋণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ১৯৯৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল রেকর্ড ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর এই হার কমতে কমতে ২০১১ সালে নেমে আসে ৬ দশমিক ১ শতাংশে। তার পর থেকে নন-পারফর্মিং ঋণ আবার বাড়তে শুরু করে।

জানা যায়, ২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। এর পর থেকে আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি বাড়তে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা, ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৭৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৯৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারা আরও জানান, পতিত সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ বিতরণে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের মতো বড় ঋণগ্রহীতারা গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাপক হারে খেলাপিতে পরিণত হন। এতে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ নজিরবিহীনভাবে বেড়ে যায়।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বদলে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের একের পর এক ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক পরিবারের হাতে ৬-৭টি ব্যাংকের মালিকানা দিতে বাড়ানো হয় পরিবারের পরিচালক সংখ্যা। ব্যাংকিং খাত একেবারে ফোকলা করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিশাল একটা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তোফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, এখন প্রায় ৩৬ শতাংশ ঋণ নন-পারফর্মিং হিসেবে শ্রেণিভুক্ত। এর যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংককে বেশি প্রভিশন রাখতে হয়, ফলে তাদের আয় কমে যায় এবং মূলধনভিত্তিক দুর্বল হয়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়েন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো লেনদেন ফি বাড়িয়ে দেয়। দেশকে অবশ্যই এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে ঋণ শ্রেণিকরণ করায় খেলাপির হার কিছুটা বেশি দেখাচ্ছে।

সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট (বিআরপিডি) শ্রেণীকৃত ঋণের তথ্য প্রস্তুত করে। তবে জুন ত্রৈমাসিকের তথ্য তারা প্রকাশ করেনি। এর পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ সরাসরি ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে, ফলে দুটি বিভাগের তথ্যের মধ্যে অমিল থাকতে পারে।