- মামলার আসামি তার পাঁচ সহযোগীও
- টানা ১৬ বছর এনায়েত উল্লাহর কবজায় ছিল পরিবহন সেক্টর
পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ চাঁদাবাজি করে তুলেছেন হাজার কোটি টাকা। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তার হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন আওয়ামী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা। গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রাথমিক অনুসন্ধানে খন্দকার এনায়েত ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির বিপুল সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে। ফলে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিন চাঁদাবাজি করে অর্জিত অর্থ পাচারের অভিযোগে ১০৭ কোটি টাকার মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ার পর রমনা থানায় মামলা দায়ের করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। গতকাল বুধবার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিআইডি জানায়, সিআইডির বিশ্লেষণে দেখা যায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৯৯টি ব্যাংক হিসাবে মোট জমা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, আর উত্তোলন হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনা ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের ৪৩টি হিসাবে জমা ৯৩৪ দশমিক ০৪ কোটি টাকা, উত্তোলন ৯০৬ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা; এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের আটটি হিসাবে জমা ৪১০ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০৮ দশমিক ২৫ কোটি টাকা এবং খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যক্তিগত ৭৪টি হিসাবে জমা ৪৫৯ দশমিক ০৮ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০২ হাজার ৭৩ কোটি টাকা।
সিআইডির অনুসন্ধান ফলাফলে দেখা যায়, ‘স্ট্রাকচারিং’ বা ‘স্মার্ট লেয়ারিং’ কৌশল ব্যবহার করে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অবৈধ অর্থ নানা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ঘুরিরে-ফিরিয়ে মোট ১০৭ কোটি ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ টাকা মানিলন্ডারিং করা হয়েছে।
সিআইডির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, অনুসন্ধানে পাওয়া প্রাথমিক সত্যতা বিবেচনায় আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খন্দকার এনায়েত উল্লাহসহ পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫)-এর ৪(২) ধারায় মামলা করেছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘বিএফআইইউ, বিভিন্ন ব্যাংক, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, বাংলাদেশ মালিক পরিবহন সমিতি এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদসহ অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ওপর ভিত্তি করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনুসন্ধানকালে ধানমন্ডির দুটি ফ্ল্যাট এবং রূপগঞ্জের দুটি প্লট বিজ্ঞ সিনিয়র স্পেশাল মহানগর জজ আদালত, ঢাকার আদেশে ক্রোক করা হয়, যার আনুমানিক দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা এবং একই আদালতের আদেশে তাদের নামে থাকা ৫৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়, যার মোট স্থিতি প্রায় ১১০ কোটি টাকা। উভয় আদেশই ৩ জুলাই কার্যকর করা হয়।’
এতে বলা হয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আশির দশকের পরে পরিবহন সেক্টরে যাত্রা শুরু করেন। পার্টনারশিপে একটি পুরাতন বাস কেনার মাধ্যমে ব্যবসার সূচনা হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রায় ২০টি বাসের মালিক হয়ে ওঠেন। এরপর অল্প সময়েই পরিবহন মালিকদের সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেন তিনি। পরে তার রাজনৈতিক পরিচয়ও ক্রমে শক্তিশালী হয়। বিএনপির রাজনীতি দিয়ে শুরু হলেও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদও লাভ করেন।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতন পর্যন্ত টানা ১৬ বছর এনায়েত উল্লাহ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ছিলেন। এই সময়ে তিনি সংগঠনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং পরিবহন সেক্টরে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল অবরোধে পরিবহন সচল রাখার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এলেও নিজের কোম্পানির বাসগুলো তিনি সড়কে নামাতেন না, যা তার কৌশলের অংশ ছিল।

