একসময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পিতল-কাঁসাশিল্প আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে আজ বিলুপ্তির পথে। নিত্যনতুন প্লাস্টিক, স্টিল, সিরামিক, মেলামাইন, কাচ ইত্যাদি সামগ্রী সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ পিতল-কাঁসার ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। নিকট অতীতেও পিতল-কাঁসাসামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হিসেবে দেখা যেত। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে। যেকোনো অনুষ্ঠানেও দেওয়া হতো নাম খোদাই করা এসব কাঁসার তৈজসপত্র। এখন শুধু স্কুল-কলেজের ঘণ্টা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঁসা।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার বিলশুকা গ্রামের মৃত বিনয় পালের ছেলে বিপুল কুমার পালের পৌর শহরের মধ্যবাজারে একটি তামা-কাঁসার ও পিতলের দোকান রয়েছে। দোকানের নাম সুপর্ণা বাসনালয়। ভেড়ামারা শহরে কিছুদিন আগেও একাধিক এ ধরনের দোকান থাকলেও বর্তমানে এটিই একমাত্র দোকান। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি ছোটকাল থেকেই কাঁসা-পিতলের দোকানে থেকেছি এবং আগে পলিশের কাজ করতাম। ২০-২২ বছর আগে নিজেই দোকান দিয়েছি। আগের তুলনায় বর্তমানে বেচাকেনা কম হয়, তার পরও পুরোনো ঐতিহ্য ব্যবসা ছাড়তে পারি না।’
বিদেশি পর্যটকেরা একসময় কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকার্যখচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র নিয়ে যেত। কিন্তু এই পিতল-কাঁসাশিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দেখারও কেউ নেই।
পিতল-কাঁসাশিল্পে জড়িত শিল্পীরা পৈতৃক পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কাঁসার তৈজসপত্র আমাদের ঐতিহ্য ও বাঙালি সামাজিক জীবনের অন্যতম সংস্কৃতির অংশ। বাঙালির গৃহস্থালি ও কৃষ্টির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প। একসময় বিয়ে, খৎনা, জন্মদিন, আকিকা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে প্রধান উপহারসামগ্রী ছিল কাঁসার গ্লাস, বাটি, ফুলদানি, চামচ, রেকাব শানকি, গামলা, বেলিবগি, পানদানি, থালা, পিতলের টব, কলসি, বালতি, কড়াই, পানের থালা, ধূপদানি, তামার কলস, হাঁড়ি-পাতিল, পুষ্পপাত্র ইত্যাদি।
তামা ও কাঁসার জিনিসপত্রের মধ্যে কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, রাজেশ্বরী, রতœবিলাস, ঘুটা ও কলতুলা নামে রয়েছে থালা ও গ্লাস। কৃষ্ণচূড়া, ময়ূরকণ্ঠী, ময়ূর আঁধার, মলিকা ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় জগ। রাজভোগী, জলতরঙ্গ, রামভোগী, গোল, কাজল, ঝিনাই, ফুলতুলি ইত্যাদি নামে রয়েছে বাটির নাম। বোয়ালমুখী, চন্দ্রমুখী, চাপিলামুখী, পঞ্চমুখী, ঝিনাইমুখী নামে রয়েছে চামচ। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই তামা, কাঁসা ও পিতলের পাওয়া যায়। পূজা-অর্চনায় মঙ্গল প্রদীপ, কোসাকুর্ষি, মঙ্গলঘট ইত্যাদি কাঁসার বাদ্যযন্ত্র উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু সেসব উপহারের স্থান দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের চীনামাটি, পাইরেক্স, মেলামাইন, প্লাস্টিক, কাচ ও স্টিল। কাঁচামাল কারিগরের অভাবে বাংলার ঐতিহ্য তামা, কাঁসা ও পিতলশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
একসময় ভেড়ামারায় কাঁসা ও পিতলের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কাঁসা ও পিতলের অপূর্ব শিল্পকর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার কাঁসাশিল্পীদের মধ্যে নামকরা অনেককেই প্রশংসা ও পদকে ভূষিত করেছেন। এদের মধ্যে প্রয়াত মধুসূদন কর্মকার, গণেশ কর্মকার, বসন্ত কর্মকার, যোগেশ কর্মকার, হারান কর্মকার উল্লেখযোগ্য। কাঁসা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। বাংলায় এই মিশ্র ধাতবশিল্প কখন, কোথায় শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শিল্প গবেষক ও নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চান। এই শিল্পকে রামায়ণ-মহাভারতের যুগের বলেও মনে করেন অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পী। বংশগত পেশায় কাঁসারশিল্পী প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র কর্মকার মনে করতেন, রামায়ণ-মহাভারতের জীবনচর্চায় পূজা-পার্বণে কাঁসার তৈরি ঘটিবাটি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারে তিনি এ ধারণা পোষণ করতেন।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, কাঁসা ধাতুটি খাদ্যকে পরিশুদ্ধ করে। সে জন্য কাঁসার বাসনে খাওয়াদাওয়া করলে হজমক্ষমতা বাড়ে, স্ট্রেস থেকে মুক্তি, শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবাণুনাশক ক্ষমতা থাকায় শরীর সুস্থ থাকে, বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায়, মস্তিষ্ককে সজাগ এবং সতর্ক করে তোলে। এ ছাড়া কাঁসার পাত্রে আধা ঘণ্টা জমিয়ে রাখা পানি খেলে শরীরের পক্ষে তা অত্যন্ত উপকারী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মোগল শাসনামলে এ দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তারা ঢাল, তলোয়ার, তির-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনামলে এই শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই শিল্পের ছোট-বড় বহু কারখানা গড়ে ওঠে।
নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যসূত্রে জানা যায়, এই শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে সময়ের রাজা প্রদ্যুৎ কুমার ঠাকুর। তিনি প্রথম এই হস্তশিল্পের সামগ্রী নিজে ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে লন্ডনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই স্বর্ণোজ্জ্বল রাজকীয় নকশার ডিনার সেট উপঢৌকন হিসেবে রাজপরিবারে পাঠিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেই প্রদর্শনীতে জামালপুরের ইসলামপুরের কাঁসার বাসন দর্শকের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার তার হাতে গড়া তৈজসপত্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কাঁসাশিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এতে করে সারা বিশ্বে কাঁসাশিল্পের পরিচিতি লাভ করে এর চাহিদা দিনে দিনে আরও বেড়ে যায়।
কাঁসার তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্র হিসেবে খ্যাত ধামরাই, শিমুলিয়া, টাঙ্গাইলের কাগমারী, বগুড়ার শিববাড়ী, রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও জামালপুরের ইসলামপুরে কাঁসাশিল্প গড়ে উঠেছিল।
এই শিল্পও কি মসলিন শিল্পের মতো বিলীন হয়ে যাবে কালের গর্ভে? নাকি পরবর্তী প্রজন্মকে আমরাও দিতে পারব একটি একান্ত আপন অনুভূতি? জন্মদিনে প্রিয়জন একটি কাঁসার গ্লাস কিংবা ফুলদানিতে নাম খোদাই করা উপহার দিলে সেটি সে আনকোরা আবেগে সযতেœ রাখবে নিজের কাছে। ব্যবহারের সময় মনে পড়বে সেই উপহারের কথা। আনমনে, আপন মনে কেউ কেউ তাকিয়ে ভাববে খোদাই করা নিজের নামে।

