ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত সম্পদের তুলনায় লুকায়িত সম্পদের পরিমাণ কয়েকশ গুণ বেশি। যা বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তার ঘোষিত সম্পদের মধ্যে সোনা ও মূল্যবান ধাতু ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখানো হলেও মাত্র দুইটি লকার থেকেই পাওয়া গেছে ৮৩২ ভরি সোনা। আর কৃষিজমি পাঁচ দশমিক দুই একর দেখালেও অনুসন্ধানে ২৯ একরের তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বর্ণালংকারের বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, ‘লকারে রাখা চিরকুটের বর্ণনা অনুযায়ী স্বর্ণালংকার শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা সিদ্দিক, তার ছেলে ববির (রাদওয়ান মুজিব) মর্মে ধারণা করা যাচ্ছে।’
শেখ হাসিনাকে ঘিরে চলমান অনুসন্ধান, জব্দ অভিযান, আদালতের নির্দেশনা ও নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে প্রশাসনিক মহল পর্যন্ত জোরালো আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ডামি নির্বাচন’ নামে পরিচিত নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী হিসেবে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক লকার খুলে বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না উদ্ধারের মতো ঘটনাগুলো ক্রমেই সামনে নিয়ে আসছে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের জটিল চিত্র।
নানামুখী তদন্ত, সম্পদ জব্দ, কর ফাঁকির অনুসন্ধান এবং এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ঘোষিত মৃত্যুদ-; সব মিলিয়ে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ও আইনি সংকটে রূপ নিয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার একাধিক অভিযোগ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিলেন এবং সেই সময়ে তিনি ও তার পরিবারের নামে বিভিন্ন সুবিধা, জমি-সম্পদ বরাদ্দ ও আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ বহুদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তার পতন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত শক্ত হওয়ার ফলে গত কয়েক মাসে ধারাবাহিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সামনে এসেছে এমন সব তথ্য, যা দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থায় নতুন এক অধ্যায় উন্মোচন করেছে। তদন্ত চলছেÑ আরও বহু তথ্য সামনে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউই।
হলফনামায় ঘোষিত সম্পদ, কী দেখিয়েছিলেন শেখ হাসিনা :
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় শেখ হাসিনা নির্বাচনি হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন। তার ঘোষিত সম্পদের মধ্যে ছিল, হাতে নগদ অর্থ দেখিয়েছিলেন মাত্র ২৮ হাজার ৫০০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা প্রায় ২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২৫ লাখ টাকা। ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) ৫৫ লাখ টাকা। মোটরগাড়ি ৩টি। যার মধ্যে একটি উপহার। বাকি দুটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সোনা ও মূল্যবান ধাতু ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আসবাব ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি কৃষিজমি দেখিয়েছিলেন ১৫ দশমিক ৩ বিঘা। যার ক্রয়মূল্য হিসেবে দেখানো হয় ৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এসব জমি রয়েছে টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ সদর, গাজীপুর ও রংপুরে।
এ ছাড়া হলফনামায় উল্লেখ ছিল, ঢাকার পূর্বাচলে একটি প্লট, মূল্য ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তিনতলা ভবনসহ ৬ দশমিক ১০ শতক জমি, মূল্য ৫ লাখ টাকা (অর্জনকালীন)।
পরিবারের জন্য বরাদ্দ ৬০ কাঠা জমি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মামলা :
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পূর্বাচলে শেখ হাসিনার নামে ১০ কাঠা প্লট বরাদ্দ ছাড়াও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার দুই সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক, সবার নামে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে এ পরিবার পেয়েছে ৬০ কাঠা সরকারি জমি। বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে, যা এখনো চলমান।
গাজীপুরের বাগানবাড়ি- বঙ্গবন্ধুর নামে লেখা জমি, পরে উত্তরাধিকার : গাজীপুরের তেলিরচালা এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে শেখ হাসিনার পরিবারের একটি বাগানবাড়ি রয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায়।
স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে এলাকার একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই ২৯৭ শতক (৯ বিঘা) জমি লিখে দিয়েছিলেন। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে জমিটির মালিক হন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে তারা জমির কিছু অংশ নিজেদের সন্তানদের নামে হস্তান্তর করেন।
দুদকের অভিযোগ, ২০০৮ সালের হলফনামায় তথ্য গোপন :
গত ২৩ নভেম্বর সিলেটে এক অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি কৃষিজমি দেখিয়েছিলেন ৫ দশমিক ২ একর, অথচ দুদকের অনুসন্ধানে ২৯ একরের তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক চেয়ারম্যান স্পষ্ট বলেন, ‘দুদক বিষয়টি নিয়ে কাজ করলেও মনোনয়ন বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা আমাদের ছিল না। দুদকের ভেতরেই অনেক সময় দুর্নীতির তথ্য চাপা পড়ে যায়, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যম এসব চাপা দেয় না বলেই সত্য সামনে আসে।’
অগ্রণী ব্যাংকের দুটি লকার থেকে ৮৩২ ভরি সোনা উদ্ধার :
সম্পদের উৎস ও কর ফাঁকির অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) সম্প্রতি শেখ হাসিনার অগ্রণী ব্যাংকের দুটি লকার জব্দ করে আদালতের অনুমতি নিয়ে খুলে দেখে। সেই লকার দুটিতে মোট ৮৩২ দশমিক ৫ ভরি সোনার গয়না রাখা ছিল।
উদ্ধার অভিযানের সময় উপস্থিত ছিলেন, সিআইসি, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর কর্মকর্তারা। এখন ওই সোনার বিবরণ শেখ হাসিনার কর রিটার্নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখায় তার আরেকটি লকার জব্দ করা হয়। যেখানে পাওয়া যায়, ১২ লাখ টাকার এফডিআর এবং ব্যাংক হিসাবে ৪৪ লাখ টাকা।
কর ফাঁকি, অবৈধ সম্পদ, দুর্নীতির বহুমুখী অনুসন্ধান :
বর্তমানে দুই সংস্থা পৃথকভাবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এনবিআর (সিআইসি) কর ফাঁকি ও সম্পদ গোপন এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতি। ইতিমধ্যে আদালতের আদেশে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদ- ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ :
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদ- দেয়। একই রায়ে তার সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই রায় কার্যকর হলে চলমান অনুসন্ধানগুলো আরও বিস্তৃত হতে পারে, মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও আত্মগোপন :
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে। ফলে একের পর এক তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। হলফনামার অপ্রকাশিত সম্পদ, কৃষিজমির অমিল, জমি বরাদ্দে অনিয়ম, কর ফাঁকি, লকারে বিপুল সোনা। সব মিলিয়ে আজ তাঁকে ঘিরে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতি-প্রশাসনিক বিতর্ক গড়ে উঠেছে।

