শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রহিম শেখ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০১:৩৭ এএম

সাউথইস্ট ব্যাংক: ছোট শাখায় বড় জালিয়াতি

রহিম শেখ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০১:৩৭ এএম

সাউথইস্ট ব্যাংক: ছোট শাখায় বড় জালিয়াতি

রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের সাউথইস্ট ব্যাংকের আটিবাজার শাখার গ্রাহক নজরুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবে ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা জমা ছিল। গত ১৬ নভেম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনের একটি এসএমএস পান তিনি। পরে ব্যাংকে গিয়ে যোগাযোগ করলে প্রিন্টারে ত্রুটি দেখিয়ে পরের দিন দুই মাস আগের ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট দেওয়া হয় নজরুল ইসলামকে। তিনি অবশ্য সেই স্টেটম্যান্টের তারিখ খেয়াল করেননি। কিন্তু গত বুধবার লোকমুখে শুনে ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারলেন তার ব্যাংক হিসাবে এক টাকাও নেই। শুধু নজরুল ইসলাম নয়, তার মতো প্রায় ৪৭০ জন গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সোহাগ। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২০ কোটি টাকা। এতে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন ব্যাংকের শত শত গ্রাহক। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে গ্রাহকদের আমানতের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠলে একের পর এক আমানতকারীরা কেরানীগঞ্জের সাউথইস্ট ব্যাংকের আটিবাজার শাখায় যোগাযোগ করতে শুরু করেন। তারা ব্যাংকে এসে হৈ-হুল্লোড়ও শুরু করেন। অনেকে নিজেদের হিসাবের স্থিতি জানতে আসেন। সুমন নামে এক ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা থাকলেও এসে দেখেন অ্যাকাউন্ট ফাঁকা। শুনেছি অনেকে গ্রাহক ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সোহাগের বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে বাড়ি ভাঙচুর করেছে। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে নুরুদ্দীন নামে এক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থাকলেও এখন মাত্র ৪ হাজার টাকা আছে। তবে কীভাবে অ্যাকাউন্ট শূন্য হলো তা জানেন না তিনি। গ্রাহক আমিনুল ইসলাম জানান, তার হিসাবে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা থাকলেও সেখান থেকে টাকা উত্তোলনের এসএমএস পান। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন অনেকের মতো তার টাকাও উধাও। বসিলার মোক্তার হোসেন মুক্তির তিনটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় কোটি টাকা লাপাত্তা হয়ে গেছে বলে জানান তার মেয়ে।

রূপালী বাংলাদেশের হাতে আসা বেশ কয়েকজন গ্রাহকের ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত মার্চ মাস থেকে বিভিন্ন গ্রাহকের অজান্তেই অর্থ সরানো শুরু করেন ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সোহাগ। অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে অর্থ হস্তান্তর করেছেন তিনি। এতে বোঝা যায়, সোগাহের আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাঠিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে গ্রাহকের মুঠোফোনে এসএমএস যাওয়ার সিস্টেম বন্ধ রাখেন তিনি। একই সঙ্গে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবও ব্লক করে রাখেন। ফলে অনেক গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হলেও কোনো এসএমএস পাননি গ্রাহকরা।

ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে আসা আখি আক্তার জানান, ব্যাংকের এ শাখা থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য এসে জানতে পারি, অনেক গ্রাহকের আমানতের টাকা নিয়ে পালিয়েছেন এক কর্মকর্তা। তবে আমার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব নাম্বার থেকে কোনো টাকা সরেনি।

বিষয়টি সম্পর্কে সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের আটিবাজার শাখায় কর্মরত এজাজ হোসেন বলেন, গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ব্যাংক হিসাব থেকে লোপাটের বিষয়টি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে অডিট বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যাংকের এই শাখায় এসে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, কতজন গ্রাহকের হিসাব থেকে কী পরিমাণ অর্থ সরানো হয়েছে অডিট কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত বিস্তারিত কিছু জানানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে ব্যাংকের অডিট ইনভেস্টিগেশনের প্রধান রেজাউল কবির জানান, কোনো গ্রাহকের টাকাই খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রতারক সোহাগের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে বলেন, আপনার এবং গ্রাহকের কথাই ঠিক (প্রায় ২০ কোটি টাকা)। জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খালিদ মাহমুদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ ঘটনায় অডিট কমিটি কাজ করছে। অডিট সম্পন্ন হলে সব গ্রাহকই তাদের অর্থ ফেরত পাবেন। এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে তিনি জানান। তবে এই ঘটনায় যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে জানতে সাইফুল ইসলাম সোহাগের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার অবস্থানের বিষয়ে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাও তথ্য জানাতে পারেননি। এই ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় কোনো অভিযোগ আসেনি বলে জানিয়েছেন থানার ওসি মনিরুল হক ডাবলু।

ব্যাংক হিসেবে লেনদেনের ক্ষেত্রে যাতে কোনো জালিয়াতির ঘটনা না ঘটে, কিংবা গ্রাহকের স্বার্থহানি না হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিমালা করেছে। টাকা লেনদেন করার ক্ষেত্রে ব্যাংক কোনো ধরনের নিয়ম অনুসরণ করবে এবং গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে সেটির প্রতিকার পাবার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বিধি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্ট এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট এসব নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, একটি স্থিতিশীল আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবার মানোন্নয়ন এবং গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সে জন্য নানা নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয়েছে। কোন ব্যাংক সম্পর্কে যদি গ্রাহকের অভিযোগ থাকে তাহলে বাংলাদেশের নম্বর ১৬২৩৬ নম্বরে ডায়াল করে অভিযোগ জানাতে পারেন। এ ছাড়া ই-মেইল করে কিংবা চিঠি দিয়ে অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে তিনটি ধাপে অভিযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রথম ধাপটি হচ্ছে; যে শাখায় ঘটনাটি ঘটেছে সে শাখায় ব্যবস্থাপকের কাছে অভিযোগ দায়ের করে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে; গ্রাহকের অভিযোগ যদি সংশ্লিষ্ট শাখা নিষ্পত্তি করতে না পারে তাহলে সেই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করা। তৃতীয় ধাপটি হচ্ছে; ব্যাংক যদি অভিযোগের প্রতিকার দিতে না পারে তাহলে গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। তবে যেসব অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন থাকে সেগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ ছাড়া অভিযোগের সপক্ষে যদি পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকে সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নিষ্পত্তি করতে পারে না। বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, তথ্য-প্রমাণ যদি গ্রাহকের পক্ষে থাকে তাহলে তার স্বার্থ কোনোভাবেই ক্ষুণœ হবে না। তিনি বলেন, গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার কোনো অভিযোগ আসলে ব্যাংক সেটিকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখে। কারণ এর সঙ্গে গ্রাহকদের আস্থার বিষয়টি জড়িত। এটা গ্রাহকদের আস্থার ব্যাপার। ব্যাংকে টাকা রাখলে এবং সেটি চলে গেলে গ্রাহক যদি প্রতিকার না পায়, সেটার প্রভাব অনেক বেশি হয়। এটা ব্যাংকাররা অনুধাবন করে। ব্যাংকাররা এটা জানে যে, কোনো না কোনোভাবে অবৈধ উপায়ে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চলে গেলে সেটা তারা দিতে বাধ্য থাকবে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। অটোমেটেড চেকবই, অনলাইন ব্যাংকিংসহ নানা পরিবর্তন হয়েছে। লেনদেনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তারপরেও মাঝ-মধ্যে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। ব্যাংকের প্রতিটি লেনদেনের একটি ট্রেইল বা পিছু দাগ থাকে। ব্যাংকের ভেতরে কাউকে না কাউকে ব্যবহার না করলে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। ব্যাংকাররা বলছেন, গ্রাহকের উচিত তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর রাখা বা আপডেট থাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রাহক যতি বেশি অংকের চেক ইস্যু করে তাহলে গ্রাহকের পক্ষ থেকে একটি সম্মতিপত্র দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা ও তার বেশি টাকার চেক পরিশোধের ক্ষেত্রে ‘পজিটিভ পে’ বা ‘গ্রাহক সম্মতি’ প্রয়োজন। ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, যেকোনো লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা খুবই সচেতন ও সাবধান থাকেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের ব্যত্যয় হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম বলছে, চেক জাল করে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ জালিয়াতি বা প্রতারণার ঘটনায় ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে যদি প্রমাণ হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা জড়িত আছে, তাহলে গ্রাহকের দাবি তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করতে হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, কোনো গ্রাহক যদি ব্যাংক কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না হয় সেক্ষেত্রে আদালতে প্রতিকার পাবার সুযোগ রয়েছে। মি. আমিন বলেন, গ্রাহকের টাকা অন্যায়ভাবে তছরুপ করে পার পাবার খুব একটা নজির নেই।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!