১৬ ঘণ্টার আগুনে নিঃস্ব রাজধানীর কড়াইল বস্তির হাজারো পরিবার। পুড়ে ছাই হয়েছে দেড় হাজারের বেশি বসতঘর ও দোকানপাট। সব হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে বস্তিবাসী। সামনের দিন নিয়ে শঙ্কায় তারা। কড়াইল বস্তিতে তাই এখন শুধু হাহাকার। এখন সম্বল বিশাল আকাশ আর সামনে থাকা পোড়া ধ্বংসস্তূপ। সর্বস্ব হারানো একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা সবাই এখন অসহায়। আমাদের কিছুই নেই, সব পুড়ে শেষ, আর কিছুই করার নেই।’ আগুনের ঘটনা তদন্তে কাজ করছে বিশেষ কমিটি। তবে কড়াইল এলাকায় বসবাসরতদের অভিযোগ, দুর্ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে, তবে বারবারই শুধু কড়াইলেই আগুন কেন? এর সঠিক কারণ বের করা উচিত।
বারবারই কড়াইলে অগ্নিকাণ্ড কোন? বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। এতে বরাবরই সহায়-সম্বলহারা হচ্ছেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তবে আগুন লাগার কারণ এবং ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে কমিটি। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিতই হচ্ছে। বিভিন্ন তদন্তে উঠে আসে এই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের নানা কারণ। এর মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো, অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগকে অগ্নিকাণ্ডের বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়। সেখানে বসবাসরত বাসিন্দাদের অসচেতনতাকে আগুনের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। আবার বারবার এসব আগুনের পেছনে নাশকতাকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। ফায়ার সার্ভিস বলছে, কড়াইল বস্তিতে পূর্বের অগ্নি দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন বস্তির অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পরবর্তী তদন্তে বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে অগ্নি দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।
শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত-দিন অবস্থান ক্ষতিগ্রস্তদের:
এসব বস্তিতে অসংখ্য বিদ্যুতের সংযোগ অবৈধভাবে টানা থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেগুলো আবার থাকে পুরোনো তারের। আবার সেই চোরাই সংযোগে হিটারও চালানো হয়। থাকে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। দাহ্য বস্তুতে বৈধ-অবৈধ অনেক কিছুই থাকে এই বস্তিতে, যার কারণে ঘনঘন অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে।
গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মহাখালী কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেড় হাজারের বেশি মানুষের ঘর-বাড়ি ও মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত পেরিয়ে দিনভর অবস্থান করেছে ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার। ঘরের ছাই ও পোড়া টিনের স্তূপের মধ্যে খুঁজে ফেরে তাদের শেষ সম্বলটুকু।
এদিকে আগুন লাগার ঘটনার পরে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের চেষ্টায় দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর গত বুধবার সকালে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহত ও প্রাণহানি ঘটেনি। কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ এই অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটিকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, ঘটছে নিয়তিম দুর্ঘটনা: আগুনের বিষয় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। আগুন লাগার পরপর বস্তির বিভিন্ন ঘরে থাকা রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার একের পর এক বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। এতে দ্রুত আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এই বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় অসংখ্য ঘর। গত বছরের ২৪ মার্চ ও ১৮ ডিসেম্বরেও আগুনে পোড়ে কড়াইল বস্তির অংশবিশেষ। প্রায় ৯০ একর জায়গার ওপর ১০ হাজারের মতো ঘর রয়েছে এই বস্তিতে। ভয়াবহ আগুনের স্বর্বস্ব হারিয়ে এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে রাজধানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা। দিন কাটছে তাদের খোলা আকাশের নিচে। পুড়ে যাওয়া মালামাল থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে অবশিষ্ট কিছু। আলেয়া নামের এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, কিচ্ছু বাঁচাতে পারিনি। বউ-ঝি-নাতি এক কাপড়ে বের হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর গুলশান ও বনানী লাগোয়া প্রায় ৯০ একর জায়গায় কড়াইল বস্তি। আগুনের লেলিহান শিখায় চোখের সামনেই পুড়ে যায় সেখানে বসবাসকারীদের শেষ সম্বল।
নিঃস্ব শত শত পরিবার, দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে-না খেয়ে:
আমার মতো নিঃস্ব শত শত পরিবার। অনেকের দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে ও না খেয়ে। নিয়তির কী খেলা, এক দিন আগে সবই ছিল তার। ঘর-সংসার সবই ভালো চলছিল, কিন্তু আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে। কথাগুলো বলছিলেন জামিলা বেগম নামের ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা। তিনি এখনো থাকছেন খোলা আকাশের নিচে। এভাবেই একাধিক মানুষ নানা ধরনের অভিযোগ করেন রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের কাছে।
৭৫ বছরের এক বৃদ্ধার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সকালে, দুপুরে সন্ধায় ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু মানুষ খাবার দিলেও সঠিকভাবে সেটা পাওয়া কঠিন। আমাদের ঘরে কিছুই নেই। আমরা এভাবে কদিন থাকব বলতে পারছি না। কী খাব? মানুষের তো ছেলেমেয়ে আছে। আয়-রোজগারের লোক নেই।
‘আল্লাহ আমারে কেন উঠায় নেয় না’ এমন অভিযোগ করে আরেক বৃদ্ধা জানান, ‘আমি এখন নতুন ঘর কোথায় পাব? সারা জীবন ধরে যা দুই-এক টাকা জমা করেছিলাম, তা-ও আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। তা ছাড়া আমার মতো হাজার হাজার ও শত শত পরিবারের দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে-না খেয়ে। সৃষ্টিকর্তা জানেন কপালে কী আছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন