শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সানিয়া তাসনিম লামিয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০২:৩৪ এএম

নৈতিক অবক্ষয় ও কেয়ামতের সতর্কবার্তা

সানিয়া তাসনিম লামিয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০২:৩৪ এএম

নৈতিক অবক্ষয় ও কেয়ামতের সতর্কবার্তা

কেয়ামত সম্পর্কিত আলামতগুলো শুধু ধর্মীয় ভয় দেখানোর বিষয় নয়; বরং মানব সমাজের নৈতিক পতন, চিন্তাধারার পরিবর্তন এবং আচরণগত সংকটকে বোঝানোর গভীর ইঙ্গিত। হাদিসে বর্ণিত ছোট আলামতগুলো এমন সব সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন, যেগুলো মানুষের চরিত্র, সম্পর্ক এবং মূল্যবোধের ভাঙনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। আর আশ্চর্য হলেও সত্যÑ আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা সেই আলামতগুলোর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।

মানুষ এখন দ্রুততার দুনিয়ায় বাস করছে। সময় যেন হাতছাড়া হয়ে যায়, দিন শেষ হয়ে যায় যেন শুরু হতেই পারে না। প্রযুক্তির সুবিধা যত বেড়েছে, মানসিক স্থিরতা তত কমেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ মানুষকে তথ্যসমৃদ্ধ করলেও গভীর জ্ঞান ও যাচাই-বাছাইয়ের অভাব তৈরি করেছে। ফলে অজ্ঞ লোকেরা জ্ঞানী সাজে, মিথ্যা সত্যের মতো ছড়িয়ে পড়ে, আর মানুষ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে বিভ্রান্ত হয়।

নৈতিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়া সমাজের আরেকটি বড় সংকট। আমানতের খেয়ানত, হোক সেটা দায়িত্ব, অর্থ, সম্পর্ক কিংবা কথারÑ আজ যেন সাধারণ ঘটনা। সততা মূল্যহীন হয়ে পড়ছে, আর প্রতারণা যেন সমাজে নতুন ‘স্বাভাবিকতা’ হয়ে উঠছে।

মানুষের আচরণেও পরিবর্তন গভীর। অশালীনতা, অশান্তি, পরিবার ভাঙন, হিংসা-বিরোধ, রাগ ও লোভÑ সবই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোট আলামতগুলো আসলে আমাদের জানিয়ে দেয়: মূল্যবোধের পতন শুরু হলো যখন মানুষ দুনিয়াকে সবকিছুর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলল এবং আখিরাতের কথা ভুলে গেল।

এসব আলামত ভয় পাওয়ার জন্য নয়Ñ বরং আত্মশুদ্ধি, সতর্কতা এবং সঠিক পথে ফিরতে সাহায্য করার জন্য।

কেয়ামতের ছোট আলামত নিয়ে একটি অনলাইন জরিপে ১,৮০০ জন অংশ নেন। জরিপে দেখা যায়Ñ প্রায় ৭২% মানুষ মনে করেন, সমাজে নৈতিকতার পতন আগের তুলনায় দ্রুত বাড়ছে। অংশগ্রহণকারীদের ৬১% বলেন, মিথ্যা ও প্রতারণা এখন স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়েছে, যা হাদিসে বর্ণিত আলামতের সঙ্গে মিলে যায়।

অন্যদিকে ৫৪% উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, ‘জ্ঞানহীন জ্ঞানীর সংখ্যা বৃদ্ধি’ বর্তমান সমাজের বড় সংকট বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য ছড়ানো। ৪৮% মানুষ বলেছেন, সময় দ্রুত কেটে যাওয়ার অনুভূতি এখন নিয়মিত, যা কেয়ামতের আলামতের একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি বলে তারা মনে করেন।

জরিপে আরও দেখা যায়Ñ ৬৭% মানুষ মনে করেন, মানবিকতা, পরিবারিক সম্পর্ক ও সহমর্মিতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ৮০% অংশগ্রহণকারী বলেন, এসব আলামত ভয়ের চেয়ে বেশি মানুষকে সচেতন ও আত্মসমালোচনামূলক হওয়ার আহ্বান।

কেয়ামতের ছোট আলামতগুলো বাস্তবে কেন দেখা দিচ্ছেÑ এর পেছনে রয়েছে মানব সমাজের গভীর পরিবর্তন, মূল্যবোধের ভাঙন এবং দুনিয়ামুখী জীবনের আধিক্য। আধুনিকতার দৌড়ে মানুষ যত এগোচ্ছে, ততই হারাচ্ছে নৈতিকতা, ধৈর্য ও আধ্যাত্মিক সংযোগ। এই বিচ্ছিন্নতাই আলামতগুলোর কারণকে স্পষ্ট করে।

দুনিয়ামুখী জীবনের লোভ মানুষকে সত্য থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতিÑ এসব অর্জনের প্রতিযোগিতায় মানুষ মিথ্যা, প্রতারণা ও বেঈমানিকে স্বাভাবিক করে নিচ্ছে। সমাজে সফলতার মাপকাঠি যখন চরিত্র নয়, জিনিসপত্রে নির্ধারিত হয়Ñ তখন মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে।

আবার জ্ঞানহীনতার বিস্তার একটি বড় কারণ। তথ্যের সহজলভ্যতা মানুষকে জ্ঞানী বানায়নি; বরং যাচাইহীন তথ্যের বন্যায় সত্য-মিথ্যার সীমা অস্পষ্ট হয়েছে। ফলে অজ্ঞ মানুষরা জ্ঞানীর ভূমিকা নিতে শুরু করেছে, যা হাদিসে উল্লেখিত আলামতের সঙ্গে মিলে যায়।

মানসিক ও পারিবারিক দূরত্ব। প্রযুক্তি মানুষের মনোযোগ ভেঙে দিয়েছে, পরিবারে সময় কমছে, সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে। এই ভাঙন সমাজে অশালীনতা, রাগ, হিংসা ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এ ছাড়া সময় দ্রুত মনে হওয়া, ব্যস্তজীবন, চাপ, এবং অন্তর্দৃষ্টির কমে যাওয়াও এই আলামতগুলোর কারণ হিসেবে কাজ করে।

কেয়ামতের ছোট আলামত সমাজে যে পরিবর্তনগুলো নির্দেশ করছে, তা আমাদের জন্য গভীর সতর্কবার্তা। এগুলো ভয় দেখানোর চেয়ে বেশি আমাদের আত্মসমালোচনা ও নৈতিক পুনর্জাগরণের সুযোগ দেয়। আমরা যদি চোখ বন্ধ করে চলি, তবে সমাজের পতন আরও দ্রুত হবে; কিন্তু সচেতন হলে পরিবর্তন সম্ভব।

আলামতগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ নৈতিকতা, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধই জীবনের আসল ধন। মিথ্যা, প্রতারণা, খেয়ানত ও লোভ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সমাজের মৌলিক বন্ধনকেও দুর্বল করে। আমাদের উচিত শিশু ও তরুণদের মাঝে সততার শিক্ষা দেওয়া এবং নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝানো।

সময় দ্রুত চলে যাওয়া, তথ্যের ভিড়, এবং প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর সমাধান হলো সচেতন জীবনধারাÑ নিজের সময়, পরিবার ও মানসিক শান্তির প্রতি মনোযোগ দেওয়া।

কেয়ামতের আলামত শুধু দুশ্চিন্তার কারণ নয়। এগুলো আমাদের শেখায়, আত্মা ও সমাজকে শুদ্ধ করতে কী করণীয়। যদি আমরা সতর্ক হই, নৈতিকতা রক্ষা করি, এবং দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে গুরুত্ব দিই, তবে সমাজে আলামতগুলোর নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব।

কেয়ামতের ছোট আলামত আমাদের জন্য সতর্কতা, শিক্ষা এবং পরিবর্তনের আহ্বান।

কেয়ামতের ছোট আলামত সমাজে যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকট নির্দেশ করছে, তা মোকাবিলার জন্য কার্যকর সমাধান প্রয়োজন। প্রথমত, নৈতিক শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। পরিবার, স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে সততা, বিশ্বাস, দয়া ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এই গুণাবলি বিকাশ করলে মিথ্যা, প্রতারণা এবং খেয়ানতের প্রবণতা কমে যাবে।

আধ্যাত্মিক সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। নিয়মিত ইবাদত, ধ্যান ও আত্মসমালোচনা মানুষকে নিজের কাজের প্রভাব বোঝায় এবং দুনিয়ার ব্যস্ততার মধ্যেও আখিরাতকে স্মরণ করায়। এটি নৈতিক মানসিকতা এবং ধৈর্য তৈরি করে।

সময় ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ব্যস্ত জীবনেও পরিবার, সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত শান্তির জন্য সময় বের করা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার কমানো এবং তথ্য যাচাই করা মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে।

সচেতন সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রশাসন, কমিউনিটি এবং ধর্মীয় নেতারা মিলিতভাবে সামাজিক ন্যায় ও দায়িত্ববোধ প্রচার করলে সমাজে অসততার বিস্তার কমানো সম্ভব।

সব মিলিয়ে, নৈতিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক সচেতনতা মিলিয়ে সমাজকে পুনরায় স্থিতিশীল ও নৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। কেয়ামতের ছোট আলামত আমাদের শুধুই সতর্ক করছে, এবং এ সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করলে আমরা নেতিবাচক প্রভাব প্রতিহত করতে পারব।

কেয়ামতের ছোট আলামত শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়; এগুলো আমাদের সতর্ক করছে সমাজ ও ব্যক্তির নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে। মিথ্যা, প্রতারণা, খেয়ানত এবং নৈতিকতা হীনতার বিস্তার রোধ করতে আমাদের দরকার নৈতিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিক সচেতনতা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। সচেতনতা এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আমরা এই নেতিবাচক পরিবর্তনকে প্রতিহত করতে পারি। তাই কেয়ামতের আলামত আমাদের জন্য শুধু সতর্কবার্তা নয়, বরং পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক, যা অনুসরণ করলে সমাজ এবং ব্যক্তি দুই নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে।

সানিয়া তাসনিম লামিয়া
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!