জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির নানা স্তরে বিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবন ঘটছে। পৃথিবীর মতো নতুন বাসস্থানের খোঁজে মঙ্গলেও অনুসন্ধান চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। উত্তর থেকে দক্ষিণ বা দক্ষিণ থেকে পশ্চিম, বিশ্বের যেকোনো দেশের বিবরণ নানা তথ্য-উপাত্তসহ এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। তবে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন উন্নত স্তরে পৌঁছেও এখনো বিশ্বব্যাপী নারীদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে না। অথচ বিশ্বব্যাপী নারীদের বৃহৎ গোষ্ঠীকে অনিরাপদ রেখে শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যদিও সব প্রতিকূলতা ঠেলে নারীরা এগিয়ে চলেছেন স্বমহিমায়, তারপরও এই এগিয়ে চলার পথে বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। সারা বিশে^র মতো দেশেও নারীর নিরাপত্তায় উদ্বেগ বেড়েছে কয়েকগুণ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নির্যাতনের শিকার নারীরা। অন্য সবকিছুতে এগিয়ে গেলেও নারীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বিশ্ব।
চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতনবিরোধী দিবসে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। জাতিসংঘের দুটি সংস্থা ইউএস উইমেন এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালে বাসাবাড়িতে থাকাকালে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন গড়ে ১৪০ জন নারী ও কিশোরী তার নিকটাত্মীয় বা পরিবারের সদস্যের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন।
মোট সংখ্যার হিসাবে, ২০২৩ সালে বিশ^ব্যাপী প্রায় ৫১ হাজার ১০০ নারী ও কিশোরীকে তাদের সঙ্গী বা পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছে। এর আগের বছর, ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৮ হাজার ৮০০ জন। হত্যা বাড়ার কারণে এক বছরের ব্যবধানে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে এমন নয়, বরং তথ্যপ্রাপ্তির উন্নতির কারণে মোট সংখ্যা বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিশ^ব্যাপী এই সহিংসতা চলছে। অঞ্চলের ভিত্তিতে আফ্রিকায় এই সহিংসতার হার বেশি। সঙ্গী ও পরিবারের সদস্যদের হাতে আনুমানিক ২১ হাজার ৭০০ জন হত্যার শিকার হয়েছে ২০২৩ সালে। জনসংখ্যার তুলনায় এই ধরনের মৃত্যুর হারও সবচেয়ে বেশি ছিল এই মহাদেশে। প্রতি ১ লাখে ২ দশমিক ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে এই অঞ্চলে। আমেরিকা এবং ওশেনিয়া মহাদেশেও এ সংক্রান্ত মৃত্যুহারের ঘটনা ছিল বেশি। আমেরিকায় প্রতি লাখে ১ দশমিক ৬ জন নারী এবং ওশেনিয়ায় প্রতি লাখে ১ দশমিক ৫ জনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিপরীতে এশিয়া ও ইউরোপে মৃত্যুহার ছিল অনেক কম। এশিয়ায় প্রতি লাখে শূন্য দশমিক ৮ এবং ইউরোপে শূন্য দশমিক ৬ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, লিঙ্গের ভিত্তিতে ঘরে ও বাইরে সংখ্যার বিচারে পুরুষ ও কিশোরেরাই হত্যার শিকার হয়েছে বেশি। তবে বাড়ির ভেতরে প্রাণঘাতী সহিংসতার বেশি শিকার হয়েছে নারীরা।
বিশ্বের কোথাও না কোথাও গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী তার আপনজনের হাতে খুন হয়েছেন। ২৪ নভেম্বর সোমবার জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় এবং জাতিসংঘ নারী সংস্থা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর ২০২৪ সালে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও মেয়েকে তাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বা পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছে।
বিশ^জুড়ে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতন বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, প্রায় ৮৪ কোটি নারী এমন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক বছরে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ৩১ কোটি ৬০ লাখ নারী ও কিশোরী শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের আগে সংস্থা ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬৮টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। তথ্য অনুযায়ী, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২০২২ সালে বৈশ্বিক বৈদেশিক সহায়তার মাত্র ০.২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৪ সালে এই বরাদ্দ আরও হ্রাস পাবে।
দেশেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন। বাসা থেকে শুরু করে কর্মস্থল- সবখানেই নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছেন নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রকট সামাজিক বাস্তবতা। স্ত্রীকে শাসন করার মাধ্যম হিসেবে এই সহিংসতার এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে, যা সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতারই বহির্প্রকাশ। এমনকি স্বাধীনভাবে চলাফেরায় নেই নিরাপত্তা।
ইউএনএফপিএ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপে উঠে এসেছে, গত ১২ মাসে স্বামীর সহিংসতার শিকার হয়েছে ৬২ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী। বিদেশে কাজে গিয়ে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার অনেক নারী শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতনের কারণে প্রতিবছর পালাতে বাধ্য হন ১৭ দশমিক ১ শতাংশ নারী শ্রমিক। বছরে গড়ে তিন থেকে চার হাজার নারী ফিরতে বাধ্য হন। দেশে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ জরুরি, বলছেন অভিবাসনকর্মীরা।
এদিকে, এসব সহিংসতা থেকে নারীদের নিরাপত্তা দেওয়া ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়ে তথ্য পেতে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কুইক রেসপন্স স্ট্র্যাটেজি (কিউআরএস) নামে ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যে জানা গেছে, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নানাভাবে গত অক্টোবর মাসে ১০১ জন কন্যা এবং ১৩০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ৯২ জন কন্যা এবং ১৩২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার আগের মাস আগস্টে ৭৯ জন কন্যা এবং ১৪৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই তিন মাসে মোট নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৭৮ জন নারী ও শিশু। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ চলতি বছরের শুরু থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও উত্ত্যক্তসহ নানা কারণে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন ফোন পেয়েছে ২৬ হাজার ৩১৭টি। এর মধ্যে স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়ে ৯৯৯এ ফোন এসেছে ১৪ হাজার ৯২৮টি। যেখানে গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ৯৯৯ মোট ফোন কল পেয়েছিল ২৩ হাজার ৩৩টি। এর মধ্যে স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের বিষয়ে ফোন ছিল ১১ হাজার ৪১৮টি। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারীরা প্রিয় মানুষের কাছেও যে অনিরাপদ, সেই তথ্যই উঠে এসেছে।

