ঢাকা শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

নাফিস সরাফাতসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ১৬১৩ কোটি টাকার অর্থ পাচার মামলা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ০১:০১ এএম
  • রয়েছে দুবাই-সিঙ্গাপুরে ফ্ল্যাট-বাড়ি
  • কৌশলে স্ত্রীকে বানান সাউথইস্ট ব্যাংকেরও পরিচালক
  • ছেলে রাহীবের নামে কানাডা, সিঙ্গাপুরে কয়েকটি ব্যাংকে ৭৬ অ্যাকাউন্ট 

পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস সরাফাতসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট গুলশান থানায় এ মামলা করে। গতকাল শুক্রবার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম পরিচালিত প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, চৌধুরী নাফিস সরাফাত তার সহযোগী ড. হাসান তাহের ইমামকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৮ সালে রেইস ম্যানেজমেন্ট পিসিএল নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। এই প্রতিষ্ঠান ২০০৮ সালে যাত্রা শুরুর পর ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে ১৩টি ফান্ড রয়েছে। মূলত এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে অবৈধ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন চৌধুরী নাফিস সরাফাত ও তার সহযোগীরা।

চৌধুরী নাফিস সরাফাত তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ এবং সহযোগী ড. হাসান তাহের ইমামের সঙ্গে মিলে ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ার কেনেন এবং পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালক পদ লাভ করেন।

এমনকি কৌশলে চৌধুরী নাফিস সরাফাত তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদকে সাউথইস্ট ব্যাংকেরও পরিচালক বানান। এরপর অভিযুক্তরা ফান্ডের টাকায় মাল্টি সিকিউরিটিজ নামক একটি ব্রোকার হাউস কিনে তার ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে প্রতারণা করে ফান্ডের অর্থ হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া চৌধুরী নাফিস সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের টাকা দিয়ে পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজসহ তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি (নিবন্ধন-২০০৭) নামের ফান্ড ক্রয়/বিনিয়োগ করেন, যার অধীন একাধিক ফান্ড রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, জাল-জালিয়াতির ব্যাপ্তি এতই বিস্তিৃত ছিল যে হিসাব বিও ও অন্যান্য ব্যাংক হিসাব খোলা, পরিচালনাসহ রাজউক থেকে একাধিক প্লট হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন নামীয় প্রতিষ্ঠান/বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে বিদেশে অর্থ পাচারের পথ সুগম করেছিলেন অভিযুক্তরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে চৌধুরী নাফিস সরাফাত ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বেস্ট হোল্ডিংসের বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চাপপ্রয়োগ, বিদেশে অর্থ পাচার এবং একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট ক্রয়সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগও প্রকাশিত হয়। এসব অভিযোগ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতেই সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান শুরু করে।

অনুসন্ধানকালে চৌধুরী নাফিস সরাফাত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ, ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরী এবং তাদেরস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে তপশিলি ব্যাংকসমূহে মোট ৭৮টি হিসাব পরিচালিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এই হিসাবগুলোতে মোট প্রায় ১৮০৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা এবং প্রায় ১৮০৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এর মধ্যে চৌধুরী নাফিস সরাফাত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ এবং ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরীর নামে মোট ২১টি হিসাব চলমান রয়েছে, যার বর্তমান স্থিতি মাত্র ২৯ লাখ ২১ হাজার টাকা। এসব হিসাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা লেনদেন হওয়ায় এই হিসাবগুলো সংক্রান্ত তথ্য বা দলিলাদি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানকালে চৌধুরী নাফিস সরাফাত ও তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ এর মালিকানাধীন কানাডায় কানাডিয়ান ম্যাপেল স্ট্র্যাটেজিক ওয়েলথ এলপি, বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট পিসিএল, রেস ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ইনকর্পোরেটেড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত কোম্পানি ব্লু ওশান সাপ্লাই লিমিটেড, লহোটসে সামিট ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড এবং আঞ্জুমান আরা শাহীদ এর নামে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (সিঙ্গাপুর) লিমিটেড, সিঙ্গাপুরে ১৫টি যৌথ হিসাব রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা জমা রয়েছে।

এ ছাড়া নাফিস সরাফতের ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরীর নামে বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব যেমন- রয়েল ব্যাংক অব কানাডা, ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক লিমিটেড, সিঙ্গাপুর, ব্যাংক অফ সিঙ্গাপুর লিমিটেড, সিঙ্গাপুর টরন্টো ডোমিনিয়ন ব্যাংকে মোট ৭৬টি হিসাব পরিচালনা করার তথ্য পাওয়া যায়।

চৌধুরী নাফিস সরাফাতের সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট এবং পাঁচ রুমের একটি ভিলা রয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরে হাসান তাহের ইমামের মালিকানাধীন নেক্সট ফ্রন্টিয়ার্স ফান্ড পিটিই লিমিটেড নামের কোম্পানিরও ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে বাংলাদেশে তাদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়েছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। প্রাথমিক অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সর্বমোট ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৯ টাকা অর্জন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) এর ২(শ) (৫) (৬)৩ (১৪) ধারায় উল্লিখিত সম্পৃক্ত অপরাধ ‘প্রতারণা’, ‘জালিয়াতি’ এবং ‘দেশি ও বিদেশি মুদ্রা পাচার’- এর অধীন হওয়ায় একই আইনের ৪ (২) ধারায় চৌধুরী নাফিস সরাফতসহ তার ৪ সহযোগীর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।