চলতে চলতে চালকসহ মোটরসাইকেল বা হাঁটতে থাকা পথিক চোরাগর্তে ডুবে গেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন ভিডিও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে আপনারও। পরে যদিও জানা গেছে ভিডিওগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি করা। কিছুদিনের ব্যবধানে বর্তমান ইন্টারনেটের জগতে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমারেখা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ফিচার আনছে এআই প্রতিষ্ঠানগুলো। উন্নত এসব এআই এখন এমন নিখুঁতভাবে ভিডিও তৈরি করতে পারে যে, কোনটা সত্যি আর কোনটা এআই দিয়ে তৈরি তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। টিকটক, ইউটিউব শর্টস কিংবা ইনস্টাগ্রাম রিলসে প্রতিদিন অসংখ্য ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, যার অনেকাংশ একেবারে বাস্তব মনে হলেও আসলে সেগুলো এআই দ্বারা তৈরি। এ কারণে অনেক সময় দর্শক বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিনোদনমূলক কনটেন্ট বানালেও, কেউ কেউ তা ব্যবহার করছে ভুল তথ্য ছড়ানো বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে। প্রযুক্তি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে কৃত্রিম জিনিসের কৃত্রিমতা প্রায় সম্পূর্ণভাবে লুকানোও সম্ভব। নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের এআই গবেষক নেগার কামালি সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কোনো ভিডিওতে ত্রুটি না পেলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না সেটি আসল।’ তবে ভিডিওর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল করলে ধারণা পাওয়া যায়, ভিডিওটি বাস্তব নাকি এআই দিয়ে বানানো। যা খেয়াল রাখতে হবে নিচে তুলে ধরা হলো
বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন
বাস্তব জগতে প্রতিটি ঘটনার প্রাকৃতিক ছন্দ থাকে। কোনো প্রাণী বা মানুষের নড়াচড়া, বস্তুর ভারসাম্য সবকিছু বাস্তবের নিয়ম মেনে চলে। কোনো ভিডিওতে যদি সেই স্বাভাবিকতা না থাকে, যেমন কোনো প্রাণী অনেক সময় ধরে একইভাবে চলাফেরা করছে বা কোনো বস্তু হঠাৎ জায়গা বদলে ফেলছে, এমন অস্বাভাবিকতা থাকলে সেটি সন্দেহজনক হতে পারে। প্রাণীরা কখনো টানা ১০ সেকেন্ড ধরে একই ছন্দে লাফায় না বা কোনো তিমি হঠাৎ একজন কর্মীকে টেনে জাহাজের ডেকে নেয় না। এসব অসম্ভব মুভমেন্টই ইঙ্গিত দেয় ভিডিওটি সিনথেটিক।
চিহ্ন খুঁজুন
অনেক ভিডিও দাবি করে যে তা সিকিউরিটি ক্যামেরা বা ডোরবেল ক্যামেরায় ধারণ করা। এই ধরনের ভিডিওতে সাধারণত সময়, তারিখ ও ক্যামেরার ব্র্যান্ড লোগো দেখা যায়। যদি এসব চিহ্ন একেবারে অনুপস্থিত হয় বা অস্পষ্ট মনে হয়, তাহলে তা এআই-নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেক সময় এই চিহ্নগুলো এআই দিয়েও কৃত্রিমভাবে যোগ করা হয়, তাই সতর্কভাবে লক্ষ্য করা দরকার।
ভিডিওর দৈর্ঘ্য
ছোট ছোট ভিডিওতে এআই-এর ভুল ধরা কঠিন হয়। তাই অনেক ভাইরাল এআই ভিডিও ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ইউসি বার্কলের অধ্যাপক হানি ফরিদ বলেন, ‘যদি কোনো ভিডিও ১০ সেকেন্ডের হয়, তাহলে তা সন্দেহের কারণ হতে পারে।’ বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় ভিডিও জেনারেটর এআই। তাই খুব ছোট বা অনেক ছোট অংশ জোড়া দেওয়া ভিডিও হলে তা এআই-নির্ভর হতে পারে।
প্রেক্ষাপটে নজর দিন
এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট পরিবেশে তৈরি হয়। অনেক সময় রাতের দৃশ্য, কম আলো বা ফিল্টারযুক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করা হয়। এতে ভিডিও দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু এসব ছাড়াও এর পেছনে আরেকটি কারণ থাকে। কম আলো বা নাইট ভিশন ধাঁচের ফিল্টার অনেক সময় এআইয়ের তৈরি ছোটখাটো ত্রুটি বা বিকৃতি লুকিয়ে রাখতে সহায়তা করে, যা মানুষের নজরে সহজে আসে না। তাই অতিরিক্ত অন্ধকার বা অস্বাভাবিক আলো-ছায়া থাকলে সন্দেহ করা যেতে পারে।
অডিওর মান
এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওতে শব্দের মান অনেক সময় অস্বাভাবিকভাবে পরিষ্কার হয় বা একেবারে নীরব থাকে। বাস্তব ভিডিওতে পরিবেশগত শব্দ, বাতাসের আওয়াজ বা হালকা ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ থাকে। যদি এগুলো অনুপস্থিত হয় বা কণ্ঠের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক শব্দের মিল না থাকে, তবে সেটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হতে পারে।
লেখার ভুল
লেখা তৈরি করতে এআই এখনো তেমন দক্ষ নয়। ভিডিওর ভেতর কোনো সাইনবোর্ড, কাপড়ের ট্যাগ, পণ্যের লেবেল থাকলে তা খেয়াল করুন। অনেক সময় বিকৃত অক্ষর, উল্টো অক্ষর, একটি শব্দ আরেক শব্দের সঙ্গে অর্থহীনভাবে মিশে থাকে। এমন লেখা থাকলে সেটি ভিডিওর কৃত্রিমতার বড় ইঙ্গিত হতে পারে।
মুভমেন্ট দেখুন
মানুষ ও প্রাণীর শরীরে সূক্ষ্ম ভর পরিবর্তন, মুখের ছোট ছোট অভিব্যক্তি, চোখের নড়াচড়া ইত্যাদি হলো বাস্তবতার ছাপ। এআই ভিডিওতে অনেক সময় এগুলো থাকে না। দেখা যায় কোনো মানুষ হঠাৎ মিলিয়ে যাচ্ছে বা চারপাশের পরিবেশ অস্বাভাবিকভাবে বদলে যাচ্ছে। এসব সূক্ষ্ম অসঙ্গতি খেয়াল করলে বোঝা যায় ভিডিওটি বাস্তব নয়।
ওয়াটারমার্ক ও মেটাডেটা
গুগল ডিপমাইন্ডের ঝুহঃযওউ বা ওপেনএআই-এর ঝড়ৎধ অনেক সময় ভিডিওতে নিজস্ব ওয়াটারমার্ক বা মেটাডেটা যুক্ত করে, যাতে বোঝা যায় ভিডিওটি এআই দিয়ে তৈরি। তবে ভাইরাল হওয়ার আগে এসব অংশ ক্রপ করে ফেলা হয়। কখনো ভিডিওর কোণে স্বচ্ছ লোগো বা আলোর হালকা ছায়া হিসেবে এসব চিহ্ন থেকে যেতে পারে।
অ্যাকাউন্টের ইতিহাস
কোনো সন্দেহজনক ভিডিও দেখলে আপলোডকারীর প্রোফাইল পরীক্ষা করুন। অনেক সময় দেখা যায় এক অ্যাকাউন্টে একের পর এক অস্বাভাবিক বা অলৌকিক ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে, যেগুলোর ধরন প্রায় একরকম। এতে বোঝা যায় এটি কোনো এআই কনটেন্ট ফার্মের অংশ; যারা নিয়মিতভাবে কৃত্রিম ভিডিও তৈরি করে।
প্রযুক্তি এবং সচেতনতা
এআই প্রযুক্তির অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর, এবং তা মানুষের কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। তবে এর অপব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। অনেক সময় মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়, যার প্রভাব সমাজে নেতিবাচক হতে পারে। তাই সচেতন ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, কোনো তথ্য ভাইরাল হওয়ার আগে যাচাই করা। প্রয়োজন হলে উৎস পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস না করা। ভবিষ্যতে হয়তো আরও উন্নত টুল তৈরি হবে, যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেবে কোনো ভিডিও এআই-নির্মিত কিনা। ততদিন পর্যন্ত সচেতন দৃষ্টিই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। ভিডিও যত নিখুঁতই হোক, সামান্য অমিল দেখলেই একটু ভেবে নেওয়া উচিত।

