ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ফায়দা লুটলেন পুলিশ কর্মকর্তা

হাসিবুল ইসলাম
প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২৫, ০৩:১২ এএম
বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক রেজাউল কবির। ছবি- সংগৃহীত

বরিশালের বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। জমি নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব ও অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তদন্ত করতে গিয়ে রেজাউল কবির নামের মাঠপুলিশের এই কর্মকর্তা বরিশাল শহরের কাউনিয়া এলাকায় বিরোধপূর্ণ ভূসম্পত্তি ক্রয় করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

এমনকি নিজ জেলার বাইরে ভূমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে পুলিশের সব আইনও তিনি উপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি পুলিশি প্রভাব খাটিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) নির্মাণ আইনও ভেঙেছেন একসময় বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানায় দায়িত্ব পালন করেন এই এএসআই। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে বরিশাল পুলিশ প্রশাসনে অভিযোগ করেছেন শহরের ৭নং ওয়ার্ডের  মাতৃমন্দির স্কুল লেনের স্থানীয় বাসিন্দা ভুক্তভোগী রিপন চন্দ্র মালী।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কাউনিয়ার বাসিন্দা মৃত কানাই লালের রেখে যাওয়া কোটি টাকা মূল্যের তিন শতাংশ ভূমি নিয়ে তার দুই ছেলে রিপন চন্দ্র মালী এবং লিটু চন্দ্র মালীর মধ্যেকার বিরোধ চলে আসছিল।

এই ঘটনায় লিটু সংশ্লিষ্ট বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানা পুলিশে একটি অভিযোগ করেন, যার তদন্তভার গ্রহণ করেন এএসআই রেজাউল কবির। তখন তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিন ভাইয়ের ভূমি সঠিকভাবে বণ্টন করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এর পরে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা দেখি, দেখছি করে করে সময়ক্ষেপণ করেন।

ভুক্তভোগী রিপন চন্দ্র অভিযোগ করেন, এর দীর্ঘদিন পরে ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর রাতে কাউনিয়া থানা পুলিশের এএসআই রেজাউল এবং এএসআই আলমগীর পুলিশের পিকআপযোগে ঘটনাস্থলে এসে গালাগাল শুরু করেন এবং ঘরবাড়ি রেখে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি প্রদান করাসহ মামলা-মোকাদ্দমায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখান।

এর কিছুদিন পরে একই  বছরের ১২ ডিসেম্বর হঠাৎ এএসআই রেজাউল কবির ৪০-৫০ জনের একটি বাহিনী নিয়ে এসে লিটু চন্দ্র মালী এবং তার বড় ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ থেকে ২ শতাংশ ভূমি ক্রয় করেছেন দাবি করেন এবং পূর্বপুরুষদের বসতঘরটি ভাঙচুর শুরু করে দেন। এ সময় এএসআই রেজাউল কবিরের নেতৃত্বে রিপন চন্দ্র মালীকে ব্যাপক মারধর করা হয়, সেই মারধরের ভিডিওচিত্র পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ির সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। 

এসব ঘটনা উল্লেখ করে ভুক্তভোগী রিপন মালী বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার এবং সিটি করপোরেশনের প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেয়ে এখন মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়েছেন। 

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এএসআই রেজাউলের এই অপকর্মের বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে জেলা পুলিশে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি বাবুগঞ্জ থানা পুলিশে কর্মরত। একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তে গিয়ে বিতর্কিত ভূমি কীভাবে ক্রয় করেন তা নিয়ে অপরাপর পুলিশ সদস্যরাও হতাশ হয়েছেন। তা ছাড়া রেজাউল করিম পটুয়াখালীর বাসিন্দা হয়ে বরিশালে স্ত্রীসহ নিজের নামে ভূমি কিনেছেন, তাও পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি ব্যতিরেকে, যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে।

তবে তদন্তে গিয়ে বিরোধপূর্ণ ভূমি ক্রয় করা এবং সেখানে নির্মাণশৈলী ছাড়াই ভবন নির্মাণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি এখন অভিযোগকারী রিপন চন্দ্র মালীকেও ক্রমাগত হয়রানির ওপর রাখছেন। ওয়ারিশদের কাছ থেকে ২ শতাংশ ভূমি ক্রয় করলেও তার বেশি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এর প্রতিবাদ করা এবং বরিশালের প্রশাসনিক মহলে অভিযোগ করায় রিপন চন্দ্র মালীকে মামলায় ফাঁসানোসহ স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের দিয়ে খুন-ঘুমের হুমকি দেন, দিচ্ছেন। 

এই বিরোধপূর্ণ ভূমি ক্রয়ের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা রেজাউল কবির বলছেন, রিপন চন্দ্র মালীর বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং তার ছোট ভাই লিটুর ২ শতাংশ ভূমি ক্রয় করেছেন। ভূমি ক্রয়ের পুরো টাকা শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়েছে।

তবে শাশুড়ি দাবি করেছেন, জমিটি পুলিশ কর্মকর্তা তার টাকা দিয়ে ক্রয় করে মেয়েকে দিয়েছেন। ফলে বোঝার অপেক্ষা রাখে না যে বিরোধপূর্ণ ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্ত কতটা ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন। তা ছাড়া নিজ জেলার বাইরে পুলিশ সদস্যদের ভূমি কিনতে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমোদন লাগে তা সম্পর্কেও কিছু জানেন না বলে স্বীকার করেন তিনি। 

পেশায় মোটরসাইকেল মেকানিক রিপন মালী অভিযোগ করেন, রক্ষক পুলিশ, ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পারিবারিক বিরোধ মেটাতে এসে তিনি নামমাত্র মূল্যে ভূমি ক্রয় করেছেন। এখন তার যে এক শতাংশ আছে তাও দখল করতে চাইছেন।

মাঝেমধ্যে পার্শ্ববর্তী পলাশপুর থেকে লোক এনে গন্ডগোল করছেন, বিষয়টি বরিশালের পুলিশ কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে জানানো হলে ঈদের আগে সাক্ষীদের নিয়ে গত পহেলা জানুয়ারি ডাকা হয়। সেখানে বিপ্লব শীল নামের একজন পুলিশ কর্মকর্তা সবার সাক্ষ্যগ্রহণ করেন।

ওসি পদমর্যাদার এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনাস্থল মেট্রোপলিটনের আওতাধীন হলেও অভিযুক্ত এএসআই রেজাউল জেলা পুলিশে রয়েছেন, তাই ঊর্ধ্বতনদের সাথে আলোচনা করে এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সব জেলা পুলিশের প্রেরণ করা হয়।

এ বিষয়ে এএসআই রেজাউল কবিরের কর্মস্থল বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শরিফ উদ্দিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, অভিযোগ পেয়েছেন, তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে নির্মাণশৈলী ব্যতিত ভবন নির্মাণ করায় রিপন চন্দ্র মালী বরিশাল সিটি করপোরেশনে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। তার অভিযোগ, বিষয়টি গত ২৭ মে সিটি করপোরেশনকে অবহিত করা হলে পরিদর্শক বাবু ঘটনাস্থল পরির্দশন করেন। কিন্তু তিনি কাজ বন্ধে কোনো ভূমিকা রাখেননি। বরং সেখানে গিয়ে এক ধরনের আপসরফা করেছেন।

এই বিষয়ে জানতে বাবুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা শোনেননি।

আইন উপেক্ষা করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি সিটি করপোরেশনের কারো যোগসূত্র থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, মন্তব্য করেন নির্বাহী কর্মকর্তা।