আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আজ। সারা বিশ্বে একসঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হবে দিবসটি। প্রতি বছরই ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়।
‘মাদক সেবন রোধ করি, সুস্থ-সুন্দর জীবন গড়ি’ এমন স্লোগানে বিভিন্ন ব্যানারে দিনটি সারা দেশে সরকারিভাবে পালিত হবে। যদিও দিনটি নিয়ে বিশ্লে কেরা বলছেন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস।
এটি শুধু একটি দিন নয়, বরং একটি প্রতিজ্ঞা মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার। আধুনিক সভ্যতার নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও মাদক আজ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সমাজ আজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে।
শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক শান্তি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও মাদকের কারণে চরম সংকটে পড়ছে। তাই এই দিবসকে ঘিরে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবেÑ কীভাবে মাদকমুক্ত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমান্ত ও আকাশপথে আসা মাদকের চালান প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়া, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, জামিনে বেরিয়ে আবারও মাদকের কারবারে জড়ানো, অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসে গুরুত্ব না দেওয়া, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, প্রভাবশালীদের বলয়ে থেকে মাদকের কারবার করা, সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে মাদকের চালান বেড়েই চলেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা মাদকের সঙ্গে সংযোগটাকে স্বাভাবিক মনে করে। বন্ধু, কোনো বড় ভাই বা কাছের কারো থেকে তাদের মাদকের যাত্রা শুরু হয়। পরে আসক্তির পর্যায়ে উপনীত হয় এবং প্রতিদিন সে মাদক গ্রহণ করে। ভয়াবহ এই মাদকগুলো কিন্তু অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
সেটি সীমান্ত, এয়ারপোর্ট বা ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ারে কোনো না কোনোভাবে দেশে আসে। সীমান্ত তো উন্মুক্ত নেই, সেটি সুরক্ষার জন্য তো ব্যবস্থাপনা রয়েছে, এই ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে মাদক প্রবেশ করে কীভাবে? যে বা যারা এসব জায়গায় দায়িত্বে আছেন, তাদের মধ্যে একটা ঘাটতি রয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই দায়িত্বে থাকা অনেকে অর্থের বিনিময়ে দেশে মাদক প্রবেশে সুযোগ করে দেন। যারা মাদক বাণিজ্য করবে বা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে বা যারা যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় এটি আরও ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। মাদক বাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে আরও ভয়াবহ মাত্রায় আসক্তির প্রবণতা বেড়ে যাবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদক গ্রহণের পর রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তার মস্তিষ্ক অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। অসংলগ্ন ভাব, সহিংস আচরণসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। মাদকাসক্তদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।
মাদকে ধুঁকছে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু:
মাদকের বিভীষিকাময় থাবায় ধুঁকছে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বাড়ছে আসক্তির প্রবণতা। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মাদকাসক্তের পরিবার। স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও নানাবিধ কারণে চিকিৎসা নিতে অনীহা মাদকাসক্ত রোগীদের। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে দিনের পর দিন অনেক পরিবার গোপন রাখে এই রোগকে। এদিকে মাদক বাণিজ্যে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে মাদক সিন্ডিকেট।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশে সরকারি ও বেসরকারি নিরাময়কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৫৩ জন মাদকাসক্ত নারী, পুরুষ ও শিশু। বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্যমতে, দেশে মাদকসেবী প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি মাদকাসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে।
মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর-তরুণ। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশ শুধু নেশার খরচ জোগাতে অপরাধ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস পালনের। মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে বাঁচতে এবং সবাইকে সচেতন করতে দেশেও দিবসটি পালিত হয়। এই দিবসকে আরও বলা হয় মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সব সময় মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আমাদেরও দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক নির্মূলে অভিযান চলছে।
নেশার টাকা জোগাতে বাড়ছে অপরাধ:
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাদক সেবনের টাকা জোগানো ও কেনাবেচা নিয়ে সংঘটিত অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। নেশার টাকা জোগাতে মাদকসেবীরা খুন করতে দ্বিধা করছে না। দিনে দিনে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। সাইমন নামে এক ব্যক্তি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন।
তার মা বলেন, সন্তানটি দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। ঘরে একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখতে হতো। বাইরে বের হলে পরিবারের লোক ও বাইরের মানুষকে মারত। কিছু বলতে গেলে আমার দিকেও মাঝে মাঝে লাঠি হাতে তেড়ে আসত। ওকে নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। সন্তানের মাদকসেবনের ব্যাপারটি আগে বুঝতে পারিনি।
পরে যখন বুঝতে পেরেছি, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথমে ওর মাদকের হাতেখড়ি হয়। পরে সেটি নেশায় পরিণত হয়। ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে কয়েকবার রিহ্যাবে দেওয়া হয়েছে। বেশি অসুস্থতার কারণে এখন আবার পরামর্শ নেওয়ার জন্য নিরাময় কেন্দ্রে এসেছি।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম জানান, মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন আসে। অসংলগ্ন আচরণ, মিথ্যা বলা ইত্যাদি বেড়ে যায়। মেজাজ খিটখিটে অথবা বেশি ঘুমাতে থাকাসহ বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এসব নজরে পড়লে সতর্ক হতে হবে।
ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম জানান, মাদক সেবনকারীরা ভালো-মন্দ কোনো কিছুই বুঝতে পারে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। তিনি বলেন, মাদকাসক্ত নারীদের ক্ষেত্রে শিশু জন্মদানের পরে শিশুটির স্নায়ুতন্ত্র গঠনে বিকৃত হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জানান, জীবনযাত্রা কেন্দ্রিক, সম্পর্ক কেন্দ্রিক, পারিবারিক কলহ, আর্থিক ও কর্মজীবনে নানা ধরনের হতাশাসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে অনেকেই। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। দেশে অনলাইন বা অফলাইন মাদকের হাটবাজার চলছেই। মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের, পরিবারের ও দেশের ক্ষতি করছে। পরিবার ও সমাজে নানাভাবে কলঙ্কের তকমা বহন করে। সামাজিক মর্যাদা হারায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে মাদক মামলা হয়েছে ৫২ হাজার ৭১৭টি। তার মধ্যে ঢাকায় ৬ হাজার ৪০৭টি। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মাদক মামলা হয় ২০ হাজার ৯২৮টি।
তার মধ্যে ঢাকায় ২ হাজার ৬৪৪টি। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

 
                             
                                    

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন