‘অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। আমাদের ওড়না নিয়ে নিছিল; আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতগুলা আসছে দেখার জন্য, এটা বলার বাহিরে। মানে, তারা একটা মজা পাচ্ছে। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেসে।’ আমার পিরিয়ড হওয়ার তারিখ ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যে টর্চার করছে, তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই যে সাথে সাথে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর ওনাদের বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’ এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করে ওরা।’ এভাবেই গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে নিজের প্রতি হওয়া নির্যাতনের বর্র্ণনা দিয়েছেন ২৫ বছর বয়সি এক তরুণী, যিনি ২০১৮ সালে পুলিশ কর্তৃক অপহরণের শিকার হয়ে প্রায় ২৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে ডিজিএফআই, র্যাব-১০ ও র্যাব-২ কর্তৃক অপহৃত হন ৪৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। তিনি ৩৯১ দিন গুম ছিলেন। তিনি কমিশনকে বলেন, ‘ঘুমাতে গেলে একজন আইসা বলতেছে, ‘এই ঘুমাইতেছেন কেন?’ মানে ঘুমাইতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পরে বালিশ সরাই ফেলত। একদম শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলছে। আর এমনি শাস্তি দিত। চেয়ার ছাড়া (খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে) বসায় রাখত। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরায় বিছানার পাশে আটকে দিয়ে রাখত। আমার এই হাতে মশা পড়লে মারতে পারতাম না। মশা কামড়াইত।’
এভাবে নির্যাতন ছাড়াও গুমের শিকার ব্যক্তিদের প্রহার ছিল নির্যাতনের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। শরীরের প্রায় প্রতিটি স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। প্রায় প্রত্যেক ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে বলে জানিয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। বন্দিদের নির্যাতনের জন্য সাউন্ডপ্রুফ বিশেষ কক্ষ তৈরি করেছিল র্যাব, যাতে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের কান্নার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যেত না বলে গুমসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবদেনে উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে গুমসংক্রান্ত কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
কমিশন জানায়, বন্দিশালার কক্ষগুলো অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ ছিল। প্রস্রাব-পায়খানার জন্য শুধু একটি বিল্ট-ইন প্যান ব্যবহার করতে হতো। তবে মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরেই পড়ে থাকত। ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন। আরো ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা, যা প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করত। ফলে টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। ভুক্তভোগীদের ১০ ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে ওষুধ ও মলম দেওয়া হতো। এরপর শরীরের দাগ মুছলে তাদের জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যে গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পদ্ধতিগত চর্চা উন্মোচনের চেষ্টা করে কমিশন। গুম করে মানুষকে গোপন বন্দিশালায় মাস ও বছরের পর বছর রাখা হতো। এসব ব্যক্তিকে নির্যাতনের জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। নির্যাতনের জন্য বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, হাত-পা বাঁধার বিশেষ রশি, নখ তুলে ফেলাসহ শারীরিক নির্যাতন করতে বিভিন্ন যন্ত্র রাখা হতো। এসব কক্ষ র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহার করত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্দিদের অর্ধেক খাবার দেওয়া হতো। গোপন বন্দিশালা থেকে ব্যক্তিদের সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে কখনো চোখে গামছা বেঁধে, কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হতো।
২০২৩ সালে ডিএমপির সিটিটিসি ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তিকে গুম করে ১৪ দিন গোপন বন্দিশালায় রেখেছিল। ওই ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, ‘মারধরের সময় একাধিক লোক থাকত। দু-তিনজন মিলে পেটাত। মারতে মারতে বলত, তোর মাংস-হাড্ডি আলাদা করে ফেলব।’
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের শরীরে একাধিক স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে কমিশন। ২০১৭ সালে ২৩ বছরের এক যুবককে অপহরণ করে গুম করে র্যাব-১১। তাকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে পা ওপরের দিকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার নাভির দুপাশে নির্যাতনের এখনো দাগ রয়েছে।
২০২২ সালে সিটিটিসি ৪৬ বছরের এক ব্যক্তিকে গুম করে ২৫৩ দিন আটকে রেখেছিল। তাকে টানা ২৪ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়। এ জন্য চারটি শিফটে সিটিটিসির কর্মকর্তারা ভাগ হয়ে নিয়েছিলেন। হাত ছাদের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন করতেন র্যাবের সদস্যরা। নির্যাতনের একটি কমন বিষয় ছিল নখ তুলে ফেলা। র্যাব সদস্যরা এই কাজ প্রায়ই করতেন। এ ছাড়া নখের ভেতরে সুঁই ঢুকিয়ে দিতেন, বাঁশ দিয়ে নির্যাতন করতেন, বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ওয়াটারবোর্ডিং, অর্থাৎ মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া হতো। এ সময় তিন-চারজন টর্চার সেলের মেঝেতে হাত-পা দিয়ে চেপে ধরতেন।
ভুক্তভোগীদের যৌন হয়রানি করা হতো। কেউ কেউ লজ্জায় কমিশনকে এই ঘটনা বলতে চাননি, তার পরও কয়েকজন বন্দি এ বিষয়ে মুখ খোলেন কমিশনের কাছে। বন্দিদের প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।
গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, গুমের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে। তারা গুম করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গোপনে নির্যাতন করত। এ জন্য তাদের অনেক আয়োজন ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।

 
                             
                                    


 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন