ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫

চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: ভারত-বাংলাদেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ

মরুভূমি হতে পারে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ১২:১৯ এএম

গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদে একসময়ের উত্তাল নদী এখন বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই শুকিয়ে থাকে। পানি না থাকায় ধু-ধু বালুচর এখন মরুভূমির আকার নিয়েছে। চরাঞ্চলের হাজারো মানুষসহ নদীপথে যাতায়াতকারীদের হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার বালুচর পাড়ি দিতে হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ শুকিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের উজানে এবং চীনের তিব্বত অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের কারণে এই আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিতব্য বাঁধগুলো বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যার ফলে নদটি শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত বাঁধগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। এই বাঁধগুলো বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং জনজীবনের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 

বাঁধ নির্মাণ ও জলনিরাপত্তা নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। চীনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের খবরে কপালে চিন্তার ভাঁজ ভারত ও বাংলাদেশের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করা হলে আটকে যাবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেচব্যবস্থা, টান পড়বে সুপেয় পানি সরবরাহেও। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দাবি, তিব্বত সীমান্তের বিশেষ এই অঞ্চলে বাঁধ দিলে ভাটি অঞ্চলে কম প্রবাহিত হবে পলি মাটি। রয়টার্স আরও দাবি করছে, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টির কারণ প্রকল্পের প্রকৃত তথ্য গোপন রাখা। 

ইতিমধ্যে তিব্বতে বিশাল এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করেছে চীন। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হতে চলেছে বলে দাবি দেশটির। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বলা হচ্ছে, পূর্ণ উৎপাদনে গেলে এটি যুক্তরাজ্যের সারা বছরের বিদ্যুতের চাহিদার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। প্রকল্পটি এতটাই বিশাল যে, এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থ্রি গর্জেস বাঁধের উৎপাদনকেও পেছনে ফেলবে। এই থ্রি গর্জেস জলবিদ্যুৎও চীনের। গত রোববার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করার ঘোষণা দেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে চীনের নির্মাণ ও প্রকৌশল খাতের শেয়ারের মূল্যে উল্লম্ফন দেখা গেছে। এই প্রকল্প বেইজিংয়ের কাছে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, কর্মসংস্থান ও মন্থর অর্থনীতিতে নতুন গতি আনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু ভাটির দেশগুলোতে এটি পানির নিরাপত্তা নিয়ে পুরোনো উদ্বেগকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে। কারণ, উজানে চীন যে নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণ করছে, সেই ইয়ারলুং জাংপো নদীই ভারতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদের ওপর কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। তিব্বত মালভূমিতে ইয়ারলুং জাংপো নদীর যে অংশে নতুন জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে নদীর একটি অংশ ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) চওড়া হয়ে প্রায় ২ হাজার মিটার (৬ হাজার ৫৬১ ফুট) উঁচু থেকে নিচে প্রবাহিত হয়েছে, যা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সেখানে ধাপে ধাপে পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ২০৩০-এর দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের ব্যয় ও সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া এর নির্মাণ পদ্ধতি সম্পর্কে চীন এখনো তেমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। চীনের এই বাঁধ অরুণাচল প্রদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত শুষ্ক করে দিতে পারে। পাশাপাশি ভাটির দিকে থাকা আসামসহ আশপাশের এলাকাগুলো প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

তথ্যের এই ঘাটতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ কৃষিকাজ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও পানীয় জলের জন্য দুই দেশেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঁধ নির্মাণ ও জলনিরাপত্তা নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানেরও একই অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত বিরোধপূর্ণ অঞ্চল কাশ্মীরে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা পানির উৎসগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, বিশেষ করে নয়াদিল্লি সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে। চীন সীমান্তঘেঁষা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এ বছরের শুরুর দিকে বলেছিলেন, চীনের এই বাঁধ তাদের রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত শুষ্ক করে দিতে পারে। পাশাপাশি ভাটির দিকে থাকা আসামসহ আশপাশের এলাকাগুলো প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলার বলেছেন, এই বাঁধ শুধু পানির প্রবাহ কমিয়ে দেবে এমনটা নয়; বরং এই বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চলের দিকে পলি বা কাদামাটির প্রবাহও কমে যাবে। এই পলিমাটি ভাটির বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি পুষ্টি উপাদান বহন করে।