রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের মধ্যে যারা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, তাদের ফলোআপ চিকিৎসা চালিয়ে যাবে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। নতুন করে গতকাল মঙ্গলবার কাউকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
তবে কয়েক দিনের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩৩ জন রোগী এর মধ্যে তিনজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এদিকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর মানসিক আঘাতে ভুগছে বহু শিক্ষার্থী। তাদের ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে আসছেন কাউন্সেলিং সেন্টারে। অনেক অভিভাবকও নিজে ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসকদের পরামর্শ।
গতকাল দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ রোগীরা হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পরেও বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে গেলেও তারা ট্র্যাকের বাইরে যাবে না।
ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, আজ (মঙ্গলবার) নতুন করে কাউকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকজনকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। যাদের কেবিনে দেওয়া হয়েছে তাদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এ রোগীগুলোর যত দিন চিকিৎসা করা লাগবে, তত দিন অর্থাৎ হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার পরেও আমাদের ট্র্যাকের বাইরে যাবে না। তাদের সব চিকিৎসা আমাদের হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। তাদের প্রত্যেকের তথ্য আমরা সংরক্ষণ করছি।’
তিনি আরও বলেন, বার্নের রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যাদের বেশি বার্ন হয়েছে। অপারেশনেরও প্রয়োজন হতে পারে। এগুলো সুশৃঙ্খলভাবেই করা হবে। আশা করি, ছুটি দেওয়ার পরও কোনো রোগীকে কোনো ধরনের ঝামেলার মধ্যে পড়তে হবে না।
পরিচালক বলেন, বর্তমানে ৩৩ জন রোগী ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ৩ জন আইসিইউতে, ৮ জন সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে ও ১৯ জন কেবিনে চিকিৎসাধীন। বাকিরা ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। গতকাল থেকে এ পর্যন্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। দগ্ধ সব রোগীকে ফিজিক্যাল ইনজুরির চিকিৎসার সঙ্গে মানসিক চিকিৎসার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ট্রমা ফেরাতে কাউন্সেলিংয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা: এদিকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর মানসিক আঘাতে ভুগছে বহু শিক্ষার্থী। তাদের ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে আসছেন কাউন্সেলিং সেন্টারে। অনেক অভিভাবকও নিজে ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসকদের পরামর্শ। গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভিড় রয়েছে ব্র্যাক ও বিমানবাহিনীর যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কাউন্সেলিং কক্ষে। ঘটনাস্থলে অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পও চালু রেখেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী দেবস্মিতা রায়কে নিয়ে এসেছিলেন তার বাবা মনোজ রায়। তিনি জানান, মর্মান্তিক সেই দৃশ্য চোখের সামনে দেখার পর থেকে মেয়ে আতঙ্কে রয়েছে। এখন মেঘের গর্জনেও কেঁপে ওঠে সে। কাউন্সেলিংয়ে তাকে ভয় কাটানোর পরামর্শ ও ‘ডিপ ব্র্রিদিং’ ব্যায়াম শেখানো হয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী অভ্র সাধু এখনো বাকরুদ্ধ। তার মা সুস্মিতা সাধু বলেন, ছেলের মানসিক অবস্থা দেখে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। শুধু শিক্ষার্থী নয়, ঘটনাস্থলের পাশেই থাকা অনেক অভিভাবকও ভুগছেন মানসিক বিপর্যয়ে। জেসমিন বেগম বলেন, তার সন্তান এখন ক্যাম্পাসে ঢুকতেই চায় না। তিনি নিজেই পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন, যদিও সেই দিনের স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
এদিকে ক্যাম্পাসে রাখা হয়েছে আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ। প্রতিটি ব্যাগে লেখা রয়েছে তাদের নাম ও শ্রেণির পরিচয়। অনেকেই সেই ব্যাগ দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন, কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন পুরোনো বন্ধুদের দেখে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা জানিয়ে ডা. শাহপারনেওয়াজ ইশা বলেন, রোগীদের হিস্ট্রি বা সমস্যার কথা সাধারণত বলা উচিত নয়। তারপরও যেহেতু বিমান বিধ্বস্তের পর ট্রমায় ভোগা শিক্ষার্থীরা আসছে, বিষয়টি অনেকটা ওপেন। তারা বিকট শব্দ শুনেছে। এখন ওই ধরনের কোনো শব্দ শুনলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া তাদের ঘুম হচ্ছে না। খাবারে অরুচি এবং ঘটনার কথা মনে পড়লে অনেকে কান্না করছে। অনেকের আবার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। আমরা দীর্ঘমেয়াদি এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য করণীয় কী, তা তাদের জানাচ্ছি। নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছি।
আপনার মতামত লিখুন :