ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। মার্কিন শুল্কারোপের পরই ভারত থেকে পণ্য নেওয়া স্থগিত করেছে বিশ^খ্যাত ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন, টার্গেট, গ্যাপসহ বড় মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা। উচ্চ শুল্কের কারণে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাড়তে পারে এবং ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির শঙ্কা করছেন মার্কিন ক্রেতারা। অন্যদিকে, এতে ভারতের কার্যাদেশ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
বাড়তি পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর ভারতের তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকে ভারত থেকে পোশাক কারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন।
ভারতের এনডিটিভি প্রফিট লিখেছে, ভারতীয় রপ্তানিকারকরা মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে চিঠি ও ইমেইল পেয়েছেন। যাতে বলা হয়েছেÑ পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য পাঠানো আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। বাড়তি শুল্কের বোঝা বহন করতে চান না মার্কিন ক্রেতারা। তারা এই ব্যয় রপ্তানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। উচ্চ শুল্কের কারণে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে।
এনডিটিভি জানিয়েছে, ওয়েলস্পান লিভিং, গোকালদাস এক্সপোর্টস, ইন্ডো কাউন্ট, ট্রাইডেন্টের মতো বড় ভারতীয় রপ্তানিকারকরা তাদের ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পণ্য বিক্রি করে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে।
ভারতের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্যও যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে এ খাতে মোট ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির মধ্যে ২৮ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ভারতের এখন আশঙ্কা, তারা বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের কাছে কার্যাদেশ হারাতে পারে। এ দুটি দেশ ২০ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়ছে।
ভারত থেকে রিচাকো এক্সপোর্টস চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ১১৩ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের ক্লায়েন্টদের মধ্যে আছে জে. ক্রু গ্রুপ। রপ্তানি হওয়া এই পরিমাণ পোশাক ভারতের বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হয়। রিচাকো এক্সপোর্টসের মহাব্যবস্থাপক দিনেশ রহেজা বলেন, এই শিল্পে এখন খরা দেখা দিয়েছে। আমরা নেপালের কাঠমান্ডুতে উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছি। ভারতের শীর্ষ পোশাক প্রস্তুতকারক রেমন্ডের অর্থ বিভাগের প্রধান অমিত আগরওয়াল বলেছেন, ইথিওপিয়ায় মার্কিন শুল্ক মাত্র ১০ শতাংশ। তাই তারা সেখানকার একটি কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর কথা চিন্তা করছেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। যার মধ্যে ২৫ শতাংশ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে এবং বাকি ২৫ শতাংশ ২৮ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। রাশিয়া থেকে ভারত তেল কেনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্প বুধবার এক নির্বাহী আদেশে লেখেন, ‘আমি মনে করি, ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা প্রয়োজনীয় ও যুক্তিসঙ্গত, কারণ ভারত সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাশিয়ার তেল আমদানি করছে।’ তবে নতুন করে আরোপিত শুল্ককে ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য’ বলে বর্ণনা করেছে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি: ভারত বলেছে, ‘রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনাকে সম্প্রতি নিশানা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা ইতিমধ্যে এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিÑ আমাদের আমদানি বাজারভিত্তিক এবং ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই (রাশিয়া থেকে আমদানির) এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ এবং অন্যান্য অনেক দেশও তাদের জাতীয় স্বার্থে একই কাজ করছে। ‘ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।’
ট্রাম্পের ঘোষণার দুদিন আগে ভারত বলেছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রচলিত বাজারের সরবরাহ ইউরোপমুখী হওয়ায় রাশিয়া থেকে তেল আমদানি শুরু করে নয়াদিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কড়া ভাষায় বিবৃতিতে বলেছে, তখন বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ আমদানিকে সরাসরি উৎসাহিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ‘ভারতের আমদানির লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ভোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী ও স্থিতিশীল জ্বালানিমূল্য নিশ্চিত করা। বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে এটি এক ধরনের বাধ্যবাধকতা। তবে এটি লক্ষণীয় যে যেসব দেশ ভারতের সমালোচনা করছে, তারাই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের ক্ষেত্রে এটি আমাদের মতো জাতীয় বাধ্যবাধকতা নয়।’
বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাশিয়া থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতের জন্য ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড, বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য প্যালেডিয়াম এবং সার ও রাসায়নিক আমদানি করছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনায় ভারতকে নিশানা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
নয়াদিল্লি বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ৬৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরোর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালে তাদের সেবা খাতের বাণিজ্য ছিল আনুমানিক ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ইউরো। এই অঙ্ক সেই বছরে বা পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের মোট বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। সত্যি বলতে কী, ২০২৪ সালে ইউরোপের এলএনজি আমদানি রেকর্ড ১৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে, যা ২০২২ সালের আগের রেকর্ড ১৫ দশমিক ২১ মিলিয়ন টনকে ছাড়িয়ে গেছে।
‘এই পরিস্থিতিতে ভারতকে নিশানা করা অন্যায্য ও অযৌক্তিক। যেকোনো বড় অর্থনীতির মতো ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’