মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান এখন ব্যবসায়ী ও দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখর। শতবর্ষ আগে এই এলাকায় শুরু হওয়া ‘বাংলার আপেল’খ্যাত পেয়ারা চাষ বর্তমানে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। পেয়ারা ছাড়াও এখানে আমড়া, কলা, লেবু, গাব, নারকেল, পান ও সুপারি চাষ হয়।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, ২৫ গ্রামের ১ হাজার ৯৩৫টি বাগানে ৬০৭ হেক্টর জমিতে প্রায় ২ হাজার ৭০ পরিবার পেয়ারা চাষ করছে। আর এই চাষাবাদ ও বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। কুড়িয়ানা, আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ধলহার, আতা, মাদ্রাসহ অন্তত ১০টি খালে প্রতিদিন বসে পেয়ারার ভাসমান হাট। প্রতিবছর আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত থাকে পেয়ারা মৌসুম। তবে এ বছর জ্যৈষ্ঠের শেষে ও আষাঢ়ের শুরুতে বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। কৃষি অফিস বলছে, এ বছর প্রতি হেক্টরে সাড়ে ৯ টন ফলন হয়েছে। বর্তমানে হাটে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি মৌসুমে ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেটসহ দেশের নানা স্থান থেকে পাইকাররা লঞ্চ, ট্রাক ও পিকআপে হাজার হাজার মণ পেয়ারা কিনে নিয়ে যান। একইভাবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বিপুল পরিমাণ পেয়ারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। তবে ট্রাক ও পিকআপচালকেরা অভিযোগ করেছেন, সড়কে নানা অজুহাতে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এই এলাকা প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য আকর্ষণ। খালের দুই পাড়জুড়ে সারি সারি পেয়ারা বাগান, ভাসমান বাজার আর নৌকাভ্রমণ পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। প্রতিবছর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সি মানুষ এখানে আসেন। শুক্রবার ও শনিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি হয়। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশিরাও আসছেন। তবে কিছু অসচেতন পর্যটকের কারণে সমস্যাও দেখা দিয়েছে। উচ্চৈঃশব্দে সাউন্ডবক্স বাজানো, গাছের ডাল ভাঙা ও আবর্জনা ফেলার কারণে স্থানীয়রা বিরক্ত। তাই এ বছর প্রশাসন ৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে সাউন্ডবক্স ব্যবহার ও অশ্লীল আচরণ নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এ উদ্যোগে সন্তুষ্ট স্থানীয়রা ও পর্যটকরা।
সরকারি উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার ও একটি পার্ক নির্মাণাধীন। তবে এর আগেই এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকেরা ‘পেয়ারা পার্ক’ নামে তিনটি মিনি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। সেখানে রয়েছে পেয়ারা পাড়ার ব্যবস্থা, চা-কফির দোকান, শিশুদের রাইড ও ওয়াচ টাওয়ার। প্রবেশ টিকিট জনপ্রতি ৩০ টাকা।
ফ্লোটিং পেয়ারা পার্ক ও পিকনিক স্পটের মালিক অতনু হালদার তনু জানান, তারা নিজেদের বেকারত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি পর্যটকদের বিনোদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসব উদ্যোগ নিয়েছেন।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মিলি দাশগুপ্ত বলেন, ‘টিভি ও ইউটিউবে দেখে জায়গাটির কথা জেনেছি। শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে এসেছি। একসঙ্গে পেয়ারা বাগান, ভাসমান বাজার আর পার্কÑ সব কিছুর আনন্দ নেওয়া যায় এখানে।’
এ বিষয়ে নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, পেয়ারার এই এলাকায় আসা পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে একটি রেস্ট হাউস এবং একটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলমান। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও পর্যটকদের ভ্রমণ নিরাপদ করতে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় পুলিশি পাহারাসহ সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি সবাইকে প্রশাসনের নির্দেশাবলি মেনে চলার আহ্বান জানান।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন