ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অভিবাসন বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল লন্ডন 

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১১:০৮ পিএম

** ‘লড়ো নয়তো মরো’ বার্তা মাস্কের
* অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে বক্তব্যে ব্রিটেনের সরকার পরিবর্তন চাইলেন মাস্ক
* গ্রেপ্তার ২৫ জন
* বিক্ষোভে প্রায় দেড় লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিল, বলেছে পুলিশ
* রেকর্ডসংখ্যক আশ্রয় আবেদন হয়ে উঠেছে ব্রিটেনের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু 

ব্রিটেনে অভিবাসন এখন বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এ ইস্যু দেশটির দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগকেও ছাপিয়ে গেছে। ব্রিটেনে এখন রেকর্ডসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন জমা পড়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ২৮ হাজারের বেশি অভিবাসী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে এসে দেশটিতে পৌঁছেছে। 

সেন্ট্রাল লন্ডনে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। ডানপন্থি নেতা টমি রবিনসনের আহ্বানে শনিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৩টার পর সেন্ট্রাল লন্ডনের হোয়াইট হলে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। খবর বিবিসির। 

বিক্ষোভে একটি গান গাওয়া হয়, যার কথা ছিল: ‘পশ্চিমকে মধ্যপ্রাচ্যের মতো করে তোলা হচ্ছে’। এরপর তারা মুসলিম ব্রাদারহুড, ইসলামিক স্টেট ও ফিলিস্তিনের পতাকা প্রদর্শন করে, যা দেখে জনতা ধিক্কার জানায়। এরপর প্রতিটি পতাকা ছিঁড়ে ফেলা হলে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এরপর রবিনসন মঞ্চে উঠে বলেন, ‘ব্রিটেন অবশেষে জেগে উঠেছে’ এবং ‘এই আন্দোলন কখনো শেষ হবে না’। 

খবরে বলা হয়, ‘ইউনাইট দ্য কিংডম’ শীর্ষক এ কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন আয়োজকদের বিভিন্ন নেতা। ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ নেন।

বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ‘সরকার পরিবর্তনের ডাক’ দেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘আপনারা পারবেন না; আমাদের চার বছর অপেক্ষা করা বা পরবর্তী নির্বাচন যতদিনেই (অনুষ্ঠিত) হোকÑ এটি বেশ দীর্ঘ সময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু না কিছু করতে হবে। পার্লামেন্ট ভেঙে নতুন ভোট আয়োজন করতে হবে।’

ইলন মাস্ক ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি মনে করি ব্রিটিশ হওয়ার মধ্যে একটি সৌন্দর্য আছে এবং আমি এখানে যা ঘটতে দেখছি তা হলো ব্রিটেনের ধ্বংস। শুরুতে এটি ছিল ধীর ক্ষয়, কিন্তু এখন ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের মাধ্যমে ব্রিটেনের ক্ষয় দ্রুতগতিতে বাড়ছে।’

রবিনসনের আসল নাম স্টিফেন ইয়াক্সলে-লেনন। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রীয় অনিয়ম উন্মোচনকারী সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেন। সমাবেশে যোগ দেওয়া সমর্থক সান্ড্রা মিচেল বলেন, ‘তাদেরকে এদেশে অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হবে।’ 

অন্যদিকে পাল্টা বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষক বেন হেচিন বলেন, ‘ঘৃণার ধারণা আমাদের বিভক্ত করছে। আমি মনে করি, আমরা যত বেশি মানুষকে স্বাগত জানাব, দেশ হিসেবে আমরা তত বেশি শক্তিশালী হব।’

শনিবারের এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা ইংল্যান্ডের ও ব্রিটেনের পতাকা হাতে যোগ দেন।

রবিনসের এই ‘ইউনাইটেড দ্য কিংডম’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষ ওয়েস্টমিনস্টার সেতুর ওপর দিয়ে মিছিল করে ডাউনিং স্ট্রিটের কাছে সমাবেশ করেছে। সমাবেশে ধনকুবের ইলন মাস্কের মতো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সুপরিচিত অনেক কট্টর ডানপন্থি ব্যক্তিত্ব বক্তৃতা দেন।

রবিনসনের এই আয়োজনে বক্তাদের মধ্যে আরও ছিলেন ফরাসি কট্টর ডানপন্থি রাজনীতিক এরিক জেমুর ও জার্মানির অভিবাসনবিরোধী দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) পেতর বিস্ত্রন। জেমুর তার বক্তৃতায় ডানপন্থি শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের তথাকথিত ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্বই আওড়ান, যেখানে বলা হচ্ছে, ইউরোপে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের সংখ্যালঘু বানিয়ে ফেলা হবে।

যুক্তরাজ্যের মধ্যপন্থি লিবারেল ডেমোক্রেটদের নেতা এড ডেভি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিবাসনবিরোধী এ কর্মসূচি, তাতে মাস্কের বক্তব্য দেওয়া এবং বিক্ষোভকে ঘিরে হওয়া সহিংসতার সমালোচনা করেছেন। ‘এই কট্টর-ডানপন্থি গুন্ডারা ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করে না,’ বলেছেন তিনি।

এদিন অনেক বিক্ষোভকারী ইংলিশ ও ব্রিটিশ পতাকা নিয়ে বিক্ষোভে হাজির হয়েছিলেন, তাদের সমাবেশ ঘিরে আশপাশের এলাকাগুলোতে কয়েক ঘণ্টা টান টান উত্তেজনাও ছিল। ভিড় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার সময় ‘অগ্রহণযোগ্য সহিংসতায়’ ২৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে পুলিশ। শনিবারের বিক্ষোভে আনুমানিক এক লাখ ১০ হাজার থেকে দেড় লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে বলে ভাষ্য মেট্রোপলিটন পুলিশের।

এই সংখ্যা ‘আয়োজকদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি’; বিক্ষোভকারীদের একটা অংশ পাল্টা-বিক্ষোভকারীদের কাছের ‘নিরাপদ এলাকায়’ ঢোকার চেষ্টা করলে সংঘাত বাধে, বলেছে তারা। অভিবাসনবিরোধীদের কর্মসূচি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে ‘স্ট্যান্ড আপ টু রেসিজম’ মিছিল হয়, এতে হাজার পাঁচেক লোক অংশ নেয়। দুই পক্ষকে আলাদা রাখতে প্রায় এক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ।

এমন এক সময়ে লন্ডনে অভিবাসনবিরোধী এ বিক্ষোভ হলো যখন ব্রেক্সিটের সমর্থক নাইজেল ফারাজের ডানপন্থি রিফর্ম ইউকে জনমত জরিপগুলোতে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে এবং শরণার্থীদের রাখা বিভিন্ন হোটেল বিক্ষোভকারীদের নিশানায় রয়েছে।

গত বছর যুক্তরাজ্যের অনেক শহরে অভিবাসনবিরোধী দাঙ্গাও হয়েছে। রবিনসনের বিরুদ্ধে সে সময় অনলাইনে উত্তেজনামূলক পোস্ট দিয়ে দাঙ্গা উসকে দেওয়ায় অভিযোগও ছিল। ৪২ বছর বয়সী রবিনসন দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইনে অভিবাসনবিরোধী ও মুসলমানবিরোধী নানা ধরনের পোস্ট করে আসছেন। শনিবারের কর্মসূচিকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘বাক স্বাধীনতার উৎসব’ হিসেবে।

‘লাখো দেশপ্রেমিক, দেশপ্রেমের এমন ঐক্য আগে কখনো দেখা যায়নি,’ সন্ধ্যার আগে আগে কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর জমায়েতের ছবি এক্সে পোস্টে করে বলেন রবিনসন, যার আসল নাম স্টিফেন ইয়াক্সলে-লেনন। কর্মসূচিটি যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকদিন আগে গুলিতে নিহত ডানপন্থি অ্যাক্টিভিস্ট চার্লি কার্ককেও উৎসর্গ করেন তিনি।

শনিবারের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকের হাতেও ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্র কার্কের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। অনেকের ব্যানারে ছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের বিরুদ্ধে স্লোগান, কেউ কেউ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকা থামানোর আকুতি নিয়ে লিখে এনেছিলেন ‘স্টপ দ্য বোটস’।

যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ অভিবাসীর উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত বিক্ষোভে যোগ দেওয়া ২৮ বছরের রিচিও। তিনি ছোট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রতিবছর আসা অভিবাসীর সংখ্যাকে ‘আক্রমণ’ হিসেবেই দেখছেন। তাদের মাইলখানেক দূরে বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশে দীর্ঘদিনের লেবার আইনপ্রণেতা ডায়ান অ্যাবট অভিবাসনবিরোধী রবিনসন ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে শরণার্থীদের হুমকি হিসেবে দেখিয়ে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘বিপজ্জনক’ মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ এনেছেন।

‘শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানো দরকার আমাদের, আমরা যে ঐক্যবদ্ধ তা দেখানো দরকার,’ স্কাই নিউজকে বলেছেন এ রাজনীতিক।