ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

‘লালনকন্যা’ ফরিদা  পারভীনের চিরবিদায়

রূপালী প্রতিবেদক ও কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১১:১২ পিএম

দেশবরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীনকে কুষ্টিয়ায় দাফন করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে শিল্পীকে শেষ বিদায়ের সময় আত্মীয়স্বজনসহ স্থানীয় হাজারো ভক্ত উপস্থিত ছিলেন। এর আগে লালন গানের সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মরদেহ শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আনা হলে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান। পরে মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হয়।

সেখানে বাদ জোহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় কুষ্টিয়ায়। শিল্পীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাফন করা হয় কুষ্টিয়ার পৌর কবরস্থানে, মা-বাবার কবরের পাশে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’-এর মতো লালন সাঁইয়ের জনপ্রিয় গান তার কণ্ঠে মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। শ্রোতারা ভালোবাসে তাকে ‘লালনকন্যা’ উপাধি দিয়েছিলেন।

গত শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন (৭১)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেওয়া এ বরেণ্য শিল্পী গানে গানে ৫৫ বছর কাটিয়েছেন। তিনি স্বামী ও চার সন্তান রেখে গেছেন। কিডনি জটিলতা ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। চলতি বছর তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় এবং পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।

কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীনের ১৯৬৮ সালে ১৪ বছর বয়সে তার পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। এরপর গানে গানে তিনি কাটিয়েছেন ৫৫ বছর।  লালনের গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত।

শুরুতে নজরুল সংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’-এর মতো লালন সাঁইয়ের জনপ্রিয় গান তার কণ্ঠে মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। শ্রোতারা ভালোবাসে তাকে ‘লালনকন্যা’ উপাধি দিয়েছিলেন।

লালনগীতিতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন।

ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। ১৯৫৭-৫৮ সালে চার-পাঁচ বছর বয়সে তাকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্ন জনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন তিনি। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুল সংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতার পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার পারভীনের যোগাযোগ, তখন তিনি কুষ্টিয়ায় থাকতেন। সেখানে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তার কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনগীতির তালিম নেন।