নিয়োগের পর পাঁচ বছর পার হলেও নানা জটিলতায় ঝুলে আছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বিভিন্ন বিভাগের ৮৮৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া। এমনকি বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আটকে আছে তাদের বেতন-ভাতাও। বেবিচক বারবার অডিট আপত্তির দোহাই দিচ্ছে। অথচ অতীতে অডিট আপত্তি পাস কাটিয়ে সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামানকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে রিট চলমান থাকা অবস্থায় পুরো পেনশন দিয়ে বিদায় করা হয়েছে সহকারী প্রকৌশলী (ইএম) ভবেশ চন্দ্র বিশ^াসকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও চাকরি শেষ হয়নি ছয় কর্মকর্তার। উল্টো তাদের ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়েছে। প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও চলতি দায়িত্ব দিয়ে প্রধান প্রকৌশলী করা হয়েছে জাকারিয়া হোসেনকে। এ নিয়ে বিদায়ি সদস্য (প্রশাসন) আপত্তি তুললেও ধোপে টেকেনি। বছরের পর বছর ধরে বেবিচকে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চললেও ৮৮৬ কর্মীর বেলায় যত আইনকানুনের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। নানা শর্তের ঘেরাটোপে তাদের বেতন-ভাতা আটকে রাখা হচ্ছে।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ৩০৬তম বোর্ড সভায় এসব কর্মীর বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু বাড়তি এই বেতন তুলতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। শর্ত অনুযায়ী, ভবিষ্যতে কোনো কারণে অডিট আপত্তি উঠলে এসব কর্মীর বাড়তি বেতনের পুরো অর্থ ফেরত দিতে হবে। এই শর্ত মেনে মুচলেকাও দিতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, জনপ্রশাসন প্রবিধানমালার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে মুচলেকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এই শর্তে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
জানা গেছে, গত ৩০ জুন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৩০৬তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৮৮৬ কর্মীর বেতন বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আড়াই মাস পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করতে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠায় বেবিচকের প্রশাসন বিভাগ।
বেবিচকের প্রশাসন বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবিদুল ইসলামের সই করা চিঠিতে বলা হয়, বোর্ড সভার ২-এর ক নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেবিচকের নবসৃষ্ট পদসমূহে যোগদানকারীদের মধ্যে দুই বছর অতিক্রম হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শর্ত সাপেক্ষে বার্ষিক বেতন বাড়ানোর বিষয়ে বোর্ড কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভবিষ্যতে বার্ষিক বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো অডিট আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত প্রদান করতে হবে মর্মে তাদের কাছে থেকে লিখিত (মুচলেকা) গ্রহণ করতে হবে। চিঠিতে এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্রে জানা গেছে, বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ওই কর্মীদের বেতন বাড়াতে সম্মত হলেও এতে নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ভবিষ্যতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির কারণে কোনো কর্মকর্তা বা অডিট কর্তৃপক্ষ আপত্তি উত্থাপন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত দিতে হবে। এ জন্য তাদের কাছ থেকে আগেই লিখিত (মুচলেকা) নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, বেতন বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রবিধান শিথিলের বিষয়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব পাঠানো হবে। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধান অনুসারে প্রদত্ত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচক চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর ১১ (৩) ধারা শিথিল করার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বেবিচক কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কারণে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধানমালার আলোকে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যা পরে বেবিচকের চাকরি প্রবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বেতন বৃদ্ধি কার্যকর করতে গেলেই অডিট আপত্তি আসতে পারে।
বেবিচকের চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, নবনিযুক্তদের শিক্ষানবিশকাল দুই বছর। এ সময় তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নেই। ফলে প্রবিধান অনুযায়ী, শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার পর তাদের চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা এবং স্বাভাবিক নিয়মে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রবিধানমালার বেশ কয়েকটি ধারা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
প্রবিধানের ধারা ৮ অনুযায়ী, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকার যেভাবে নির্ধারণ করবে, সেভাবেই দেওয়া হবে। আবার জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ধারা ১০ (১)-এ বলা আছেÑ সব কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির তারিখ হবে প্রতি বছর ১ জুলাই। নতুন যোগদানকারী কর্মচারী যদি ন্যূনতম ছয় মাস চাকরি করেন তাহলে তিনি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। অথচ চাকরি প্রবিধানমালা ২০২১-এর ধারা ৬ (৫) বলছে, অস্থায়ীভাবে সৃষ্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি শিক্ষানবিশ হিসেবে গণ্য হবেন না। তবে অস্থায়ী পদ যেদিন স্থায়ী হবে, সেদিন থেকে তার চাকরিও স্থায়ী হবে। এ ছাড়া ধারা ১১ (৩) অনুযায়ী, কোনো শিক্ষানবিশ সফলভাবে শিক্ষানবিশকাল শেষ না করলে এবং চাকরিতে স্থায়ী না হলে তিনি বেতন বৃদ্ধির অধিকারী হবেন না।
প্রবিধানের জটিলতা এড়াতে মুচলেকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩০৬তম বোর্ড সভা। আর এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বেবিচকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দাবি, প্রবিধান অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে যেটা পাওয়ার কথা, সেখানে মুচলেকা দিয়ে ভবিষ্যতে টাকা ফেরত দেওয়ার শর্ত মেনে নিতে হচ্ছেÑ এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং চাকরি প্রবিধানের লঙ্ঘন।
ভুক্তভোগী একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, বর্ধিত বেতন তুলতে এমন শর্ত ‘মনগড়া’ ও আইনবহির্ভূত। সরকারি চাকরির প্রবিধানমালায় কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তার চাকরি সরাসরি স্থায়ী হওয়ার বিধান রয়েছে। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বর্ধিত বেতন পেতে এ ধরনের আজব নিয়ম এর আগে কেউ কখনো শোনেনি।
এদিকে ১২০০ কর্মচারী নিয়োগের বিরুদ্ধে চলা তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। প্রশাসন বিভাগের কেরানি জাহিদ, রোকনুজ্জামান ও মমিনুল ইসলামকে এ বিষয়ে তলব করা হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপপরিচালক আবিদুল ইসলাম ১৫ বছর ধরে প্রশাসনে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। নিয়োগকালীন মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক বর্তমানে অডিট বিভাগের পরিচালককেও জবাববদিহির আওতায় আনা হয়নি।
বেবিচকে এখনো আওয়ামী দোসরদের জয়জয়কার চলছে। এদের একজন চলতি দায়িত্বের উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারীরা তাকেসহ ছয়জনকে নানা তকমা দিয়েছিল। মানববন্ধন করে প্রত্যাহারও দাবি করেছিল। কিন্তু আমলে নেয়নি বেবিচক। উল্টো পদোন্নতি দিয়ে উপপরিচালক পদে স্থায়ী করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) লাভলু রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতা নেই, বেতন বৃদ্ধি নিয়ে জটিলতা আছে। তাদের চাকরি নতুন। প্রবিধানে বলা আছে, এই কর্মীদের চাকরির মেয়াদ তিন বছর পর পর বাড়াতে হয়। বিষয়টি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি আগামী মাসখানেকের মধ্যে এটি অনুমোদন হয়ে যাবে। আমরাও তাদের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে তারা বকেয়াসহ সব পাওনা পেয়ে যাবেন।