জাতীয় মাছ ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সারা দেশে গতকাল শুক্রবার রাত ১২টা থেকে টানা ২২ দিন মাছ ধরা, পরিবহন, মজুত, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই সময়কালে মেঘনা, পদ্মা ও বিভিন্ন উপকূলীয় নদ-নদীতে কঠোর অভিযান চালাবে প্রশাসন। মৎস্য অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী, ইলিশ সংরক্ষণে প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে নজরদারি হবে এবার আরও কঠোর। এবার নজরদারির জন্য ব্যবহার হবে ড্রোন।
সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইলিশের খনি হিসেবে পরিচিত বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদী এলাকায়। এখানে প্রায় ৮২ কিলোমিটার নদীপথে ড্রোন বসিয়ে পাহারা দেবে নৌ পুলিশ। পাশাপাশি কোস্ট গার্ড, র্যাব, পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তারা যৌথ অভিযান চালাবেন। জেলার ঝুঁকিপূর্ণ মৎস্য পল্লী ও ইউনিয়নগুলোয় প্রতিদিন প্রচার-প্রচারণা, সভা-সমাবেশ ও লিফলেট বিতরণ চলবে।
এ ছাড়া সারা দেশের নদ-নদীতে মা ইলিশ নিধন ঠেকাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল জেলায় নিবন্ধিত ৭৯ হাজার জেলের মধ্যে ৬৬ হাজার ৫২৪ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে ২৫ কেজি করে চাল। তবে জেলেদের অভিযোগ, এই চাল সময়মতো হাতে পৌঁছায় না, অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দও কম দেওয়া হয়। ফলে মহাজনের দাদনের চাপ ও কর্মসংস্থানের অভাবে তারা বিপাকে পড়েছেন।
জেলেরা বলছেন, ‘মাত্র ২৫ কেজি চাল দিয়ে মাসের সংসার চলে না। মাছ ধরা বন্ধের সময়ে সরকার যদি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করত, তাহলে আমরা আরও স্বস্তিতে আইন মেনে চলতে পারতাম।’
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ জানিয়েছেন, গত বছর প্রায় ৪০ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন কমেছে। এ বছরও উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কা আছে। তার মতে, মা ইলিশ রক্ষার জন্য কড়া নজরদারি জরুরি হলেও শুধু অভিযান দিয়ে সফলতা আসবে না, জেলেদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রয়োজন।
মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, এ মৌসুমে মা ইলিশ সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে উঠে আসে এবং আশ্বিন মাসের ভরা পূর্ণিমায় ডিম ছাড়ে। বিশেষত লক্ষ্মীপুরের রামগতি, মৌলভীর চর, ঢালচর, সৈয়দ আওলিয়া ও লতাচাপলি পয়েন্টে মা ইলিশ বেশি আসে। এই সময় যদি তাদের ডিম ছাড়ার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে ইলিশ উৎপাদন আরও কমে যাবে।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দেশের বিভিন্ন জেলার মাছঘাট ও বরফকলেও অভিযান চলবে। বরফ ব্যবহার করে কেউ যেন ইলিশ সংরক্ষণ না করতে পারে, সে জন্য কিছু স্থানে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুযায়ী, এ সময়ে কেউ মাছ ধরলে বা ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিক্রয়ে জড়িত হলে জেল-জরিমানা ও আইনি শাস্তি দেওয়া হবে।
প্রশাসনের আশাবাদ, ড্রোন নজরদারি ও যৌথ অভিযানের ফলে এবার মা ইলিশ সংরক্ষণে আগের চেয়ে বেশি সফলতা আসবে। তবে জেলেদের দুশ্চিন্তা ও সংকট সমাধানে স্থায়ী কর্মসংস্থান ও কার্যকর পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে কি নাÑ সে প্রশ্নও জোরালো হয়ে উঠছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন