ঢাকা বুধবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৫

পায়রা সমুদ্রবন্দর

পায়রায় উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে ব্যয়ের অনুমোদন চায় মন্ত্রণালয়

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২৫, ০৩:২৫ এএম

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পায়রা সমুদ্রবন্দরের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে নতুন বাজেট অনুমোদন দিয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পরিচালন বাজেটের আওতায় ‘ভবন ও স্থাপনাসমূহ’ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোনো কাজ শুরু করা বা অর্থ ব্যয় করা সম্ভব না। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে চিঠি দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। চিঠির সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থ ছাড় চেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি এসেছে। এই বিষয়ে পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।

সরকারি সূত্র জানায়, বন্দরের প্রথম টার্মিনালের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং খুব শিগগিরই পূর্ণমাত্রার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। তবে পশ্চাৎপদ এলাকায় পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার অভাব ও সীমিত অবকাঠামো অপারেশন পরিচালনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক স্থাপনা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সম্প্রসারণসহ নতুন অবকাঠামো উন্নয়নকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে বন্দরের ব্যবহারকারীদের জন্য বিদ্যমান কমার্শিয়াল ভবন যথেষ্ট নয়। তাই নতুন ফ্লোর নির্মাণের কাজ চলছে, যার মধ্যে চারতলা ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সংকট নিরসনে নতুন আবাসিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

নতুন উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছেÑ জি-টাইপ ভবন (দুই তলা) নির্মাণ। দুটি টুইন স্টাফ ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও প্রথম তলা নির্মাণ। আবাসিক এলাকায় ড্রেন নির্মাণ এবং কমার্শিয়াল ভবনের চতুর্থ তলা নির্মাণ।

সূত্র মতে, এসব অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে বন্দরের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আধুনিক আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। ইতোমধ্যে আবাসিক ভবনের জন্য ফাউন্ডেশনসহ একটি ব্লকের কাজ শেষ হয়েছে, যা দ্রুত ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে।

অন্যদিকে, অর্থ বিভাগ ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে একটি পরিপত্র জারি করে ‘আবাসিক ভবন’ ও ‘অন্যান্য স্থাপনা’ খাতে ব্যয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে পায়রা বন্দরের গুরুত্ব বিবেচনায় অর্থ বিভাগ বিশেষ অনুমোদন দিয়ে বরাদ্দ ব্যয়ের পথ খুলে দিলে অসমাপ্ত কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

পায়রা বন্দরের সম্প্রসারণ কার্যক্রমের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার তিনটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেÑ জেটি নির্মাণ, টার্মিনাল সম্প্রসারণ, গভীরপথ খনন ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, গুদাম ও সংযোগ সড়ক উন্নয়নে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

এ পর্যন্ত সম্প্রসারণের জন্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। টার্মিনাল সম্প্রসারণে ২ হাজার ২০০ কোটি, নৌপথ খননে ১ হাজার ১০০ কোটি এবং সংযোগ সড়ক উন্নয়নে ৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, বাকি কাজ শেষ হলে এটি হবে দেশের সবচেয়ে আধুনিক বন্দর, যেখানে বছরে এক কোটিরও বেশি কন্টেইনার ওঠানামা করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৬ সালে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হলে জাতীয় অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের অতিরিক্ত চাপ অনেকটা হ্রাস পাবে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুত হবে এবং ব্যবসায়িক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। সরকার প্রতিবছর এখান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পায়রা বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণে এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল ও ভুটানের জন্য একটি কার্যকর সমুদ্রপথ হতে পারে। মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও পণ্য পরিবহন সহজ হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পায়রা বন্দর চালু হলে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, কাঁচামাল সরবরাহ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্প দ্রুত গড়ে উঠবে। এতে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের মতে, পায়রা বন্দর চালু হলে প্রবৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ২ শতাংশ যোগ হতে পারে। বিশেষ করে পোশাক, চামড়া ও মৎস্য খাত বৈদেশিক আয়ের বড় উৎসে পরিণত হবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব বা অর্থায়নে জটিলতা তৈরি হলে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া কঠিন হতে পারে। তাই পরিকল্পনার স্বচ্ছতা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে, পায়রা সমুদ্রবন্দর শুধু একটি অবকাঠামোগত প্রকল্প নয়Ñ এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি নতুন অধ্যায় হয়ে উঠতে যাচ্ছে।