দেশে ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের চিত্র ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। গত ৯ মাসে অন্তত ৬৬৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চারশ শিশু। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে দুজনেরও বেশি নারী বা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন তথ্য প্রমাণ করে অপরাধের মাত্রা কতটা ভয়াবহ। সমাজে প্রশ্ন উঠছে, কোথায় তাদের নিরাপত্তা? কেন বারবার শিশুদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও অত্যাচার ঘটছে? কখন আমরা একটি সুরক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। যেখানে শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। বর্তমানে কোথাও যেন নিরাপদ নয় কন্যাশিশুরা।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এই পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ৮৬ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আগস্ট মাসে ১১৫ ও সেপ্টেম্বর মাসে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩২। গত ৩ মাসে ৩৩৩-এর বেশিই ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
এইচআরএসএস এই পরিসংখ্যান বলছেন, শুধু সংখ্যা নয়, এটি আমাদের সমাজের গভীর ক্ষত, নৈতিক অবক্ষয় এবং সর্বব্যাপী এক সামাজিক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিবেদনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ-হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা এবং চাঁদপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন নারী বা গাজীপুরের রিসোর্টে নাট্যকর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো সমাজের সর্বস্তরে নারী-নিরাপত্তার ভঙ্গুরতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। তেমনি ময়মনসিংহ, কুমিল্লা বা গাজীপুরে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও স্পষ্ট করছে, এখন আর কোনো জায়গা, কোনো পরিবার নিরাপদ নয়। শুধু শহর নয়, গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র ধর্ষণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় দিনের বেলায় এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় তার বাবার মর্মস্পর্শী আর্তি যেন দেশের হাজারো ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, বিলম্বিত বিচার এবং তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার কারণে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। তা ছাড়া এর পেছনে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও নৈতিক স্খলনসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। একাধিক আইনজীবী বলছেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অনেক সময় নথিপত্রে তথ্য-প্রমাণাদি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে, যা বাদীপক্ষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং সমাজে এক ধরনের ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ তৈরি করে। যখন অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয় বা অপরাধী পার পেয়ে যায়, তখন অন্যান্য সম্ভাব্য অপরাধী উৎসাহিত হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস মনে করেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নারীর নিরাপত্তা মানে সমাজের নিরাপত্তা। প্রতিটি শিশু, প্রতিটি নারীকে নিরাপদ রাখা রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, সারা দেশের শিশু-তরুণীর ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র আমরা পাচ্ছি না। গণমাধ্যমেও সেভাবে আসছে না। গত শনিবার ঢাকার গে-ারিয়ায় এক তরুণীকে ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যার ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। আর আগের দিন মিরপুর ও বাড্ডায় শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে কোথাও না কোথাও এ জঘন্য অপরাধ ঘটছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৫ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ হাজার ৭০০। আর ২০১২-১৩ সাল থেকে এই অপরাধের সংখ্যা বাড়লেও কোভিডের সময় তা কিছুটা কমেছিল। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৫। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর মতে, শিশুদের বিরুদ্ধে যে অপরাধগুলো হচ্ছে, তার বেশির ভাগই মেয়েদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি হচ্ছে যৌন অপরাধ। ওই তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ হয়েছে ৭০ হাজার ৫৩টি। এই সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে প্রতি দিন গড়ে ৪৮৬টি করে অপরাধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯২টিই যৌন অপরাধ সংক্রান্ত। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে, যৌন অপরাধ ছাড়াও শিশুদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলাও বেড়েছে। ২০২৩ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপহরণে মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৪টি। এই সংখ্যা শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পিওসিএসও ধারায় নথিভুক্ত মামলা ৬৭ হাজার ৬৯৪ বা প্রায় ৩৮.১৭ শতাংশ।
বেসরকারি একটি সংস্থার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশে কোথাও সুরক্ষিত নয় শিশুরা। কারণ, দেশে বাড়ছে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ। গত ২০ বছরে এই ধরনের অপরাধ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। ২০২৩ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৫টিÑ যা সর্বোচ্চ। এটি এক ভয়াবহ চিত্র। অবশ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর মতে, এসব নথিভুক্ত মামলা এবং অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের হিসাবে দেশে প্রতি তিন মিনিটে শিশুদের বিরুদ্ধে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
২০২২ সালের তুলনায় এই অপরাধের হার বেড়েছে ৯.১৬ শতাংশ। এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর আধিকারিকরা। তাদের মতে, এর বাইরেও অনেক অপরাধ আছে, যেগুলো নথিভুক্ত হয়নি। সেগুলোও নথিভুক্ত হলে এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনি বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার বলেছেন, সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক চাপ এবং দুর্বল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক ঘটনা রিপোর্ট হয় না বা অমীমাংসিত রয়ে যায়। তদন্তে বিলম্ব এবং পারিবারিক প্রভাব ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে বলেও জানান তিনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম জানান, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা এবং জবাবদিহিতার অভাব অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুর্বল থাকে এবং শাস্তির সম্ভাবনা কম থাকে, তখন অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারের শক্তিশালী নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে শিশুদের ব্যক্তিগত সীমারেখা ও অন্যের প্রতি সম্মান শেখানো হলে তাদের ওপর নির্যাতনের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের আগে পরিবারের সঠিক দিকনির্দেশনাই হলো প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। শিশু সুরক্ষায় স্কুলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই পাঠ্যক্রমে সেফটি এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।