ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিলেটে বেশ জোরেশোরেই বইছে নির্বাচনি হাওয়া। এই মুহূর্তে নির্বাচনের প্রধান অংশীদার বিএনপি ছাড়াও অন্যতম শক্তিশালী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। ফুরফুরে মেজাজে আছেন দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে জেলা ও মহানগরের নেতাকর্মীরা। তৃতীয়বারের মতো দলের সর্বোচ্চ পদ ‘আমির’ নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াতের মূল কা-ারি ডা. শফিকুর রহমান মাতৃভূমি সিলেটে পা রাখলে তাকে বুধবার সিলেটে দেওয়া হয় উষ্ণ অভ্যর্থনা। জামায়াত নেতারা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বেশ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও। বিএনপির প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর নির্বাচন সামনে রেখে সিলেটে তার এ সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখছে দলটি। সিলেটে এসে তিনি বৈঠক করেন দলের জেলা ও মহানগরের সাথে। বসেন সিলেটের বিভিন্ন আসনে ঘোষিত দলের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের নিয়েও। এ সময় কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সূত্র জানিয়ে, দলটি সিলেটের সব কয়টি আসনে জেতার মানসিকতা ও প্রস্তুতি নিয়েই এবার মাঠে নেমেছে। আশাবাদী ভালো ফল করার। তবে পুরো সিলেট বিভাগে কম করে হলেও অন্তত ৫টি আসনে তাদের প্রার্থী বের করে নিয়ে আসতে পারবেনÑ এমনটাই মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে সিলেটে তিনটি, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে একটি করে দুটি আসন রয়েছে। গেল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চরমভাবে নির্যাতিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর প্রতি দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের যে দুর্বলতা এবং ভাবাবেগ তৈরি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত এবার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো সুফল ঘরে তুলবে বলে আশাবাদী। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও জনগণের কাছে যে গ্রহণযোগ্য জায়গা তৈরি করেছে, তাকে পুঁজি করে আসনগুলোতে ভালো ফল পেতে মরিয়া। তবে এর জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এবং আগামীতেও করতে হবে মাঠে-ময়দানে। জামায়াত বৃহত্তর সিলেটে বিএনপিকে যতটা তাদের প্রতিপক্ষ বা জয়ের জন্য বাধা মনে করে, তার চেয়ে বেশি ভয় এখানকার ইসলামি দলগুলো এবং ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। বিশেষ করে কওমি ও ফুলতলী মসলকের প্রভাবে সিলেটে জামায়াতবিরোধী বলয় বেশ পাকাপোক্ত। দলটি মনে করে, ভোটের মাঠে তারা যতটা আগাবে, তাদের ধর্মীয় প্রতিপক্ষ ততটাই তাদের পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে জামায়াত। এ লক্ষ্যে সিলেটের কওমি ঘরানার আলেম ও ফুলতলী মসলকের সাথে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
গেল বছর সিলেট এমসি কলেজে ইসলামী শিবির কর্তৃক তালামিয কর্মীর ওপর হামলার পর দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা ফুলতলী দরবার শরিফে গিয়ে পীরে কামেল, শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী সাহেব রহ.-এর কবর জিয়ারত করেন। একটি সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ নির্বাচন সামনে রেখে শিগগিরই জামায়াত আমির ফুলতলী দরবারে যেতে পারেন। বিষয়টি জামায়াত আমিরের নিজের আগ্রহেই হবে। তবে এখনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। এ ছাড়া কওমি উলামায়ে কেরামের সাথে জামায়াতের আমির নিজেই যোগাযোগ করে কুশলাদি নিচ্ছেন বলে ওই সূত্র দাবি করে।
অপরদিকে বিএনপি ধর্মীয়গোষ্ঠীর ভোটব্যাংকে হানা দিতে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও দলের বিশেষ বার্তা নিয়ে নগরীর সোবহানীঘাটে আল্লামা ফুলতলী রহ. প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আনজুমানে আল ইসলাহের সাথে বৈঠক করেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ও সিলেট-৩ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এম এ মালেক।
সিলেটের ধর্মীয় ভোট টানতে বিএনপির এমন তৎপরতার বিষয়টিকে জামায়াত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। তারাও সমমনা ধর্মীয় রাজনীতির সাথে আসন সমঝোতার পাশাপাশি ধর্মীয় বলয় ও মতাদর্শের ভোট নিজেদের ঘরে আনতে চেষ্টা করছে। এটিতে সফল হলে সিলেটে কয়েকটি আসনে বের হয়ে আসা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে জামায়াতের জন্য। বিশেষ করে যে ৫ আসনে জামায়াত তাদের জয় নিয়ে আশাবাদী সেই সিলেট-৫, সিলেট-৪, সিলেট-৩, মৌলভীবাজার-২, সুনামগঞ্জ-২ আসনে ফুলতলী মসলক ও কওমির বড় একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। জয়ের পাল্লা তাদের ভোট অনেকটা ভারি করে দিতে পারে জামায়াতকে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার তারা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভোট নিজেদের পাল্লায় নিয়ে আসতে পারলে ভালো একটা সুফল পাবে বৃহত্তর সিলেটে।
জামায়াত অনেক আগেই সিলেটসহ সারা দেশে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। এর পরপরই প্রার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ভোটের মাঠে। ওই সময় সাড়া ফেললেও গত দুর্গাপূজার সময় ম-পে ম-পে অতিমাত্রায় তৎপরতা দেখানোয় বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ধর্মীয় অনুশাসনে থাকা সিলেট অঞ্চলে। এটি জামায়াত কর্মী ও সমর্থক ছাড়া যারা তাদের শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিষয়টি গেল সরকারের সময়ে নির্যাতিত জামায়াতের প্রতি সাধারণ মুসলমানদের যে দুর্বলতা ও ভাবাবেগ তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকটা ভাটা পড়ে। জামায়াত নেতাকর্মীরা এটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
জামায়াত সূত্র মতে, সিলেটের ৬ আসনেই তারা জয়ের লক্ষ্যে প্রার্থী দিয়েছেন। বিশ্বাসও করেন, সবগুলো আসনে তারা জয় নিয়ে বেরিয়ে আসবেন। তবে সিলেট জেলায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা আসনগুলোর মধ্যে দলের নেতাকর্মীরা সিলেট-৫ আসনকে সামনে রাখছেন। সিলেটের একমাত্র এই আসনেই অতীতে জামায়াত সংসদের টিকিট পেয়েছিল মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। এবারও সেই আসনে তারা ভালো করতে চায়। এখানে প্রার্থী হয়েছেন জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আনোয়ার হোসেন খান। তবে এবার বেরিয়ে আসতে হলে তাকে মাড়িয়ে আসতে হবে শক্ত বাধা। বিএনপি ছাড়াও কওমি ঘরানা ও ফুলতলী মসলকের ভোট তারা পাবেন না। নির্বাচনে কওমি অঙ্গনের আছেন অন্তত ৩ প্রার্থী। তাদের মাঝেই ভাগ হয়ে যাবে কওমির ভোট।
আদর্শগত ও সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্কের আরও বেশি তিক্ততার কারণে ফুলতলী মসলকের ভোট পাওয়ার আশা শূন্যের কোটায়। জয় আনতে হলে নিজেদের ভোটব্যাংক দিয়েই আনতে হবে। সিলেট-৪ প্রার্থী হয়েছেন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও সাবেক জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন। এলাকায় বেশ জনপ্রিয় নেতা তিনি। তবে তাকে মোকাবিলা করতে হবে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে। শেষ পর্যন্ত আরিফ প্রার্থী থাকলে এ আসনে কঠিন লড়াই হবে তাদের মাঝে।
তবে আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিরোধের জন্য কওমি অঙ্গনের পুরো ভোটব্যাংক সুনজরে তাকাবে না জয়নাল আবেদিনের দিকে। আসন সমঝোতা হলে একটি অংশের ভোট পাবেন জয়নাল। সিলেট-৩ আসনে আছেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা লোকমান আহমদ। তার অবস্থানও বেশ ভালো। বিএনপির শক্ত ঘাঁটিতে প্রার্থী হয়েছেন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা এম এ মালেক। জয়ী হয়ে বেরিয়ে আসার প্রত্যাশী অপর আসনের মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া উপজেলা)। এটি জামায়াতের আমিরের বাড়ি। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এ আসনে তিনি প্রার্থী হলেও হতে পারেন। তবে জামায়াত এ আসনে প্রার্থী দিয়েছে মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের আমির এম শাহেদ আলীকে। ফুলতলী মসলকের বিশাল ভোটব্যাংক থাকা এ আসনে বেরিয়ে আসতে হলে তাকে তাদের ভোট টানতে হবে। এটি সম্ভব হলে সহজে তিনি নির্বাচনি বৈতরণী পার হবেনÑ এমনটাই মনে করেন স্থানীয়রা। ৫ম যে আসনে জয়ী হওয়ার আশার আলো দেখছে জামায়াত, সেটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা)। এ আসনে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আলোচিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনিরকে। তবে এ আসন আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি।
সিলেটে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী সিলেট জামায়াতের অন্যতম নীতিনির্ধারক ও জেলা জামায়াতের যুব বিভাগের সভাপতি, সিলেট-৩ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী লোকমান আহমদ। বলেন, সিলেটের ৬টি আসনেই জামায়াত জয়লাভ করবেÑ এই বিশ্বাস আমাদের। মাঠের ফলাফল অন্তত তা-ই বলে। মানুষ পরিবর্তন চায়। আমাদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও প্রত্যাশা প্রত্যেকটি আসনে জয় এনে দেবে। তিনি বলেন, আমাদের প্রার্থীরা এখন জনগণের কাছে। দলীয় জনশক্তি মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে। মানুষ যে সাড়া দিচ্ছেন, তা অভূতপূর্ব। এ জন্য আমরা আশাবাদী অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় জামায়াত দারুণ ফলাফল করবে এবং চমক দেখাবে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে।

