ঢাকা বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫

বিমানের স্ট্রংরুমে রহস্যজনক চুরি

খোয়া যাওয়া পণ্যের হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা

মাইনুল হক ভূঁইয়া ও দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৫, ০১:৩২ এএম

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের স্ট্রংরুমে গত ১৭ অক্টোবর আগুন লাগার পর চুরি ও লুটপাটের রেশ না কাটতেই ফের চুরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সিলগালা ভেঙে ২৮ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা চুরির ঘটনায় খোয়া যাওয়া পণ্যের হিসাব নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি।

২৯ অক্টোবর কর্তৃপক্ষের দ্বিতীয় দফা ইনভেন্ট্রিতে দেখা যায়, স্ট্রংরুমের ভল্টে চুরির পর ভাঙা ভল্টে পাওয়া গেছে ৮০টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুলসংখ্যক ম্যাগাজিন ও কার্তুজ। চুরির পর এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ অন্য মালামাল পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রথম দফা ইনভেন্ট্রিতে অস্ত্রের সংখ্যাটি দেখানো হয় ১৪টি, যা ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে নিয়মিত পরিদর্শনের সময় তদন্তকারী দল ২ নভেম্বর ভল্টে থাকা ২১ অস্ত্রের মধ্যে দুই রকমের ৭টি অত্যাধুনিক অস্ত্র চুরির ঘটনা ধরা পড়ে। চুরি হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-৪ কারবাইন ও ব্রাজিলের তৈরি টরাস পিস্তল। তবে কোন অস্ত্র কতটি চুরি হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ চুরির গোটা বিষয়টিই এখনো ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে।

রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভয়াবহ অগ্নিকা-ে সিসি ক্যামেরা পুড়ে যাওয়া এবং বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার সুযোগে স্ট্রংরুমের তালা ভেঙে লুটপাট চালায় অপরাধী চক্র। ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

প্রশ্ন উঠেছে, বিমানবন্দরের নিñিদ্র নিরাপত্তার মাঝে সিলগালা ভাঙা হলো কেমন করে। ১৭ অক্টোবর আগুনের ঘটনার পর ১০ দিনÑ অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত স্ট্রংরুমে পণ্যসামগ্রী অক্ষত ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর স্ট্রংরুমের তালা ভেঙে ফের চুরির ঘটনা অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এ ঘটনার পর জিডি হয়েছে, তদন্ত কমিটিও হয়েছে। শিগগিরই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হবেÑ বিমান উপদেষ্টার এমন ঘোষণার পরও তদন্ত শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে দুই দফা ইনভেন্ট্রির পরও চুরি হওয়া পণ্যের সঠিক হিসাব পেতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে আগুন লাগার সুযোগে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য লুটের ঘটনাটি কারো আলোচনায়ই নেই। বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টাও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

জানা গেছে, চুরির আগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে সব পণ্য তাদের হেফাজতে নিয়ে যেতে চিঠি দেয় বিমান। বলা যেতে পারে, চিঠিটি আমলে নেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ওদিকে গত ২৮ অক্টোবর সকালে চুরির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বিমানবন্দর থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পুরো এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করে। পরদিন ২৯ অক্টোবর ভাঙা স্ট্রংরুমের সামনে পাঁচ সাক্ষীর উপস্থিতিতে মালামালের তালিকা করা হয়।

বিমানবন্দর থানা পুলিশের জব্দ তালিকায় দেখা যায়, ভাঙা স্ট্রংরুম থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় ৬৭টি অত্যাধুনিক পিস্তল, ১২টি শটগান, একটি অ্যাসল্ট রাইফেল, পিস্তলের ১৩৮টি খালি ম্যাগাজিন, ৯মিমি ব্ল্যাংক কার্টিজ ৯৯১ পিস, শটগান ও রাইফেলের খালি ম্যাগাজিন।

ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পরও স্ট্রংরুম প্রায় অক্ষতই ছিল। অধিকাংশ আগ্নেয়াস্ত্রের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রের প্লাস্টিক বাঁট, ব্যারেলের নিচের স্প্রিং ও ম্যাগাজিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দর কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দরের কার্গো আমদানি হাউসের স্ট্রংরুমের ভল্টে সাধারণত মূল্যবান জিনিসপত্র ও জরুরি নথিপত্র (আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, শুল্ক-সংক্রান্ত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক দলিলপত্র) রাখা হয়। এ ছাড়া খুব বেশি মূল্যবান কিছু আমদানিপণ্যও সাময়িকভাবে ভল্টে রাখা হয়। সাধারণত স্বর্ণ, হীরা ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ উচ্চমূল্যের ও সহজে বহনযোগ্য পণ্য নিরাপত্তার জন্য এখানে রাখা হয়। সেখান থেকে পণ্য বের করতে হলে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।

তারা আরও বলেন, বিমানবন্দর ও স্ট্রং হাউস সম্পর্কে জানাশোনা আছে এমন শক্তিশালী চক্র এ চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। এ চুরিকা-ে গত ২৮ অক্টোবর বিমানবন্দর থানায় যে জিডি করা হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়, বিমানবন্দরের কার্গো আমদানি কমপ্লেক্সের স্ট্রংরুমের (ভল্ট) মালামাল ২৪ অক্টোবর বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিমান সিকিউরিটির প্রতিনিধির স্বাক্ষরসহ ভল্টে শিকল দিয়ে তালা লাগিয়ে সিলগালা করা হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর স্ট্রংরুমের ভল্টের কাছে গিয়ে কোনো তালা লাগানো দেখা যায়নি।

চুরির ঘটনা জানাজানির এক সপ্তাহ পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. মো. সাফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, গত ১৮ অক্টোবর কুরিয়ার গোডাউনে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তী সময় আমদানি কার্গো গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে কুরিয়ার ও আমদানি কার্গো গোডাউন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু আমদানি কার্গো গোডাউনের স্ট্রংরুম মেইন ওয়্যারহাউস-১ এর ভল্টে রক্ষিত মালামাল অক্ষত থাকে। তবে ভল্টের লক সিস্টেম পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। গত ২৩ অক্টোবর তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে ও ভল্টের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত আমদানি গোডাউনের ল্যান্ডসাইডের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল এভসেক, ডিএমপি পুলিশ ও বিমান নিরাপত্তা বিভাগ। ল্যান্ডসাইডে বিমান নিরাপত্তার কাছে এন্ট্রি রেজিস্টার লিপিবদ্ধ করে পুলিশ এবং বিমান নিরাপত্তার সদস্য কর্তৃক এস্কট সহকারে বিভিন্ন সংস্থা প্রয়োজনে সেখানে প্রবেশ করে। এ ছাড়া এয়ারসাইডের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল এভসেক। তারাও এয়ারসাইড দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত আমদানি কার্গো গোডাউনে প্রবেশের ক্ষেত্রে রেজিস্টারে অ্যান্ট্রি কার্যক্রম চালু রাখে।

চুরির ঘটনার ব্যাখ্যায় বিমান কতর্ৃৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, গত ২৪ অক্টোবর দুপুরে কাস্টমস, বিমান কার্গো, বিমান সিকিউরিটি, পুলিশ, এভসেক, এনএসআইয়ের উপস্থিতিতে স্ট্রংরুম ভল্টের ইনভেন্ট্রি তালিকা করা হয়। তালিকার পর সবার উপস্থিতিতে তালা সিলগালা করা হয়। ভল্টটির অবস্থান ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমপোর্ট কার্গোর ভেতরে। ইমপোর্ট কার্গো বিল্ডিং সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যেকোনো সময় ছাদ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া ছাদ থেকে ইট-সুরকি খসে পড়ছে, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তার জন্য ভল্টের সামনে প্রহরায় বিমান নিরাপত্তা বিভাগের লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। তবে বিল্ডিংটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পরে ভেতরে অবস্থান করা পুলিশ সদস্য ও বিমান নিরাপত্তা সদস্যদের বাইরে অবস্থান করতে বলা হয়। তাছাড়া অগ্নিদুর্ঘটনার পর থেকে আমদানি কার্গোতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না, সিসিটিভিও ছিল অকার্যকর।

চিঠিতে বলা হয়, নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে ভল্টের মূল্যবান মালামাল অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ করা হয়। গত ২৭ অক্টোবর সর্বশেষ ভল্টের তালা পরিদর্শনে ভল্টের মালামাল ঠিকঠাক পাওয়া যায়। তবে পরদিন ২৮ অক্টোবর সকালে ভল্টের শেকলও তালাবিহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ অক্টোবর প্রথম ইনভেন্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার পর স্ট্রংরুমের চাবি কাস্টমস ও পুলিশের নিকট হস্তান্তরের অনুরোধ করা হয়। তবে তারা অপারগতা প্রকাশ করায় বিমান নিরাপত্তা বিভাগের শিফট অফিসে চাবির বক্সে চাবি সংরক্ষণ করা হয়। বিমান নিরাপত্তা শিফট অফিসে প্রবেশাধিকার অননুমোদিত ব্যক্তির জন্য সীমিত এবং সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়। সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আপাতদৃষ্টিতে তালাটি ভাঙা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস জানায়, স্ট্রংরুমের তালা ভাঙার পর গত ২৯ অক্টোবর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে স্ট্রংরুমে রক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্রের ইনভেন্ট্রি করা হয়। এরপর বিমানবন্দর থানা পুলিশ ওই আগ্নেয়াস্ত্রগুলো নিজ হেফাজতে নিয়ে যায়।

চুরি হওয়ার আগেই মালামাল হেফাজতে নিতে ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারকে চিঠি দিয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। গত ২৫ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অবস্থিত প্রধান গুদাম-১ এর ‘স্ট্রংরুম-এ’তে রক্ষিত মালামালের ইনভেন্ট্রি যথানিয়মে সম্পন্ন হয়েছে। অগ্নিকা-ের ফলে বর্তমানে পণ্য আমদানি টার্মিনালের সব স্থাপনাসহ সব গুদাম ভস্মীভূত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু ‘স্ট্রংরুম-এ’ ছাড়া গুদামের অন্য কোথাও মালামাল অবশিষ্ট নেই। এমন স্পর্শকাতর ও নাজুক পরিস্থিতিতে স্ট্রংরুম-এতে ইনভেন্ট্রিকৃত মূল্যবান মালামাল রাখা সমীচীন হবে না। মালামালের যথাযথ সুরক্ষায় কাস্টমস হেফাজতে নেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিমান বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সফিকুর রহমানকে দুই দফা কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।