বাংলার মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য একটি সবজি হলো আলু। ভাত-ডাল হোক বা রুটি, তার পাশে একটু ভাজা বা তরকারি না হলে যেন জমে না। আজকাল বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে আলু। সঙ্গে ব্যবহার হচ্ছে প্রযুক্তি। কৃষক এখন শুধু মাটি চষেই থেমে থাকেন না; তারা জানেন, বিজ্ঞান আর পরিকল্পনাই দিতে পারে অধিক ফলন আর লাভজনক কৃষি। বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মিনহাজুর রহমান নয়ন
মাটি নির্বাচন ও প্রস্তুতি
আলু চাষের জন্য ভালো পানি নিষ্কাশনযোগ্য দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। জমি নির্বাচনের পর ৪-৫ খানা চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। জমিতে শেষ চাষের সময় সঠিক মাত্রায় জৈব সার (গোবর, কম্পোস্ট) মিশিয়ে নিতে হয়।
মাটির পিএইচ পরীক্ষা করাও এখন জরুরি ধাপ। আদর্শ পিএইচ মাত্রা ৫.৫ থেকে .৫ হলে আলুর ফলন ভালো হয়।
বীজ নির্বাচন ও রোগমুক্ত টিউবার
বীজ আলু ব্যবহার করা সবচেয়ে বেশি ভালো। অনেক চাষিরা এখন বাজারের সাধারণ আলু নয়, নির্দিষ্ট জাতের সার্টিফায়েড বীজ ব্যবহার করেন। রোগমুক্ত ও ভাইরাসমুক্ত বীজ ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। আলু পচে যায় না, ফলন বেশি হয়। জনপ্রিয় জাতসমূহ হলো- ডাইয়ামেন্ট, কার্ডিনাল, গ্রানোলা, এস্ট্রেক্স, লাল পাকরি, কুফরি জ্যোতি ইত্যাদি। বীজ আলু কেটে ব্যবহার করলে ১-২ দিন ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হয়, যাতে কাটা জায়গা শুকিয়ে যায় এবং পচন রোধ হয়।
সঠিক সময়ে চাষ
বাংলাদেশে আলু সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোপণ করা হয়। সময় অনুযায়ী রোপণ করলে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায় এবং ফলন বেশি হয়।
রোপণ পদ্ধতি
সারি থেকে সারির দূরত্ব রাখা হয় সাধারণত ৫০-৬০ সেমি, আর গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০-২৫ সেমি। আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বীজ রোপণ করলে সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হয়।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
বীজ রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ। এরপর প্রয়োজন মতো ২ থেকে ৩ বার সেচ। আধুনিক পদ্ধতিতে ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার ব্যবহার করলে পানি কম লাগে ও উৎপাদন বাড়ে।
সার ব্যবস্থাপনা
বাড়ে আধুনিক কৃষকরা এখন মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করেন। এতে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি ঠিকমতো পায়, আবার অতিরিক্ত সার প্রয়োগ এড়ানো যায়। প্রতি হেক্টরে আলু চাষে সাধারণত ব্যবহার হয় ইউরিয়া সার ২৫০-৩০০ কেজি, টিএসপি সার ২০০ কেজি, এমওপি সার ২৫০ কেজি, দস্তা, বোরন ও জৈব সার প্রয়োগও জরুরি।
রোগ ও পোকা দমন
আলু গাছে সাধারণত লেট ব্লাইট, আর্লি ব্লাইট, পাতা পচা রোগ বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া পটেটো টিউবার মথ ও পোকার আক্রমণও ক্ষতিকর।
আধুনিক পদ্ধতি
বালাইনাশক ব্যবহারের আগে ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট অনুসরণ করতে হবে, বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহার করতে হবে, রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করুন, জমিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
উত্তোলন ও সংরক্ষণ
আলু রোপণের ৮০-৯০ দিনের মধ্যে কা- ও পাতা হলুদ হয়ে গেলে ফসল উত্তোলনের সময় হয়। উত্তোলনের পর আলু ২-৩ দিন ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হয়, ক্ষতিগ্রস্ত আলু আলাদা করে রাখতে হয়, সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোল্ড স্টোরেজ বা বাঁশের ঝুড়ি ও মাটির গর্তে প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষণ করা যায়।
লাভজনক বাজারজাতকরণ
আধুনিক কৃষকেরা এখন সরাসরি বাজারের চেয়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, কো-অপারেটিভ মার্কেটিং, এবং অনলাইন কৃষিপণ্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমে ও কৃষক সঠিক দাম পান। আধুনিক প্রযুক্তি ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় আলু চাষ এখন শুধু চাষই নয়, বরং একটি লাভজনক উদ্যোগ। কৃষক যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন, তাহলে কৃষি হয়ে উঠবে আরও বেশি সমৃদ্ধ, বৈজ্ঞানিক ও টেকসই।
টিপস
সব সময় নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করুন। আবহাওয়া ও রোগ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। প্রয়োজনে অ্যাপ ব্যবহার করে ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ গ্রহণ করুন।