কবি নজরুলের ভাষায়, ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি, বাংলাদেশের মাটি।’ এ কথার শাশ্বত সত্যের প্রমাণ আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি বাংলার কৃষকের নানা উদ্যমে। কখনো তারা দেশের মাটিতে সোনার ফসল ফলিয়ে বিশ্বব্রহ্মা-ে তৈরি করেন নব বিস্ময়, আবার কখনো একই মাটিতে বিদেশি ফসলজাত ফলিয়ে করে ফেলেন বিশ্ব জয়। সম্প্রতি এমনই কিছু কৃষি উদ্যোক্তার উদ্যোগে দেশের মাটিতেই চাষ হচ্ছে ফিলিপাইনের কালো আখ। গাঢ় কালো-বেগুনি রঙের কা-, উচ্চ চিনির পরিমাণ এবং নরম জাতের এই বিশেষ ধরনের আখ এখন বাংলাদেশের কৃষকের নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। এই আখের চাষ পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছেন নরসিংদীর তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মারুফ হাসান মুরাদ। তুলে ধরেছেন আরফান হোসাইন রাফি
বিশেষত্ব
ফিলিপাইনের কালো আখ মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে জনপ্রিয় এক জাত। এর কা- সাধারণত গাঢ় কালো থেকে বেগুনি রঙের হয়, যা চোখে পড়লেই আলাদা করে দৃষ্টি কাড়ে। স্বাদে এটি দেশীয় আখের তুলনায় কিছুটা নরম এবং মিষ্টতা বেশি। চিনির পরিমাণ সাধারণত ১৮-২১ শতাংশ পর্যন্ত থাকে, যা দেশীয় জাতের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। এ কারণেই আখের রস থেকে গুড়, চিনি বা সরাসরি পানীয় তৈরির ক্ষেত্রেও এই জাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি এবং জলাবদ্ধতা বা খরার প্রভাবও অন্যান্য জাতের চেয়ে ভালোভাবে সহ্য করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুতেও এটি সহজে মানিয়ে নেয়।
চাষের সময় ও জমি প্রস্তুতি
কালো আখ চাষের জন্য অক্টোবর থেকে জানুয়ারি সময়টি সবচেয়ে উপযুক্ত। চাষের শুরুতেই জমি ভালোভাবে চাষ করে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার, গোবর ও টিএসপি সার ব্যবহার করলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে এবং আখের গঠন মজবুত হয়। মারুফের মতে, প্রতি হেক্টরে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কাটিং বা সেট (চারা টুকরা) প্রয়োজন হয়। প্রতিটি সেটে দুই থেকে তিনটি গিট থাকা আবশ্যক। লাগানোর সময় ৪-৫ ফুট দূরত্বে সারি তৈরি করে চারা বসাতে হয়। আখ গাছের বৃদ্ধি দ্রুত করতে প্রথম দিকের ৬০ দিনে সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। সাধারণত ১০-১২ মাসের মধ্যে আখ সংগ্রহযোগ্য হয়। তবে উপযুক্ত যতেœ কিছু এলাকায় ৮-৯ মাসেই আখ কাটা সম্ভব হয়।
চাষ পদ্ধতি
চাষের সময় সঠিক জাত নির্বাচন, জমির অবস্থান ও সেচব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আখ রোপণের ৩০ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিনে একবার করে সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাতা হলুদ হয়ে গেলে ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে হয়; এতে গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া পোকামাকড় দমনে জৈব কীটনাশক বা নিমপাতার নির্যাস ব্যবহার করা ভালো, কারণ আখের রস সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ফলে রাসায়নিক কীটনাশক এড়ানো উচিত।
বাজার দর
ফিলিপাইনের কালো আখের কা- নরম ও মিষ্টি হওয়ায় বাজারে রস বিক্রেতা ও গুড় উৎপাদক উভয়ের কাছেই এর চাহিদা বেশি। বর্তমানে বাজারে দেশীয় আখ পাইকারি বিক্রি হয় প্রতি পিসে প্রায় ৭০-৮০ টাকা, যেখানে ফিলিপাইনের কালো আখ বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়। অর্থাৎ দেশীয় আখের তুলনায় ২০-৩০ শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যায়। তা ছাড়া এর রং ও আকারের কারণে শহরাঞ্চলের রস বিক্রেতা ও ফল বিক্রেতাদের কাছেও এটি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করেছে। মারুফের হিসাবে, প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন খরচের তুলনায় দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। তার মতে, ‘দেশীয় আখে যেখানে লাভ কমে যাচ্ছে, সেখানে ফিলিপাইনের কালো আখ কৃষকদের জন্য নতুন এক সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে।’
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে আখ চাষ এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, জমির উর্বরতা হ্রাস ও বাজারের অস্থিরতার কারণে অনেক কৃষক এখন অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। তবে ফিলিপাইনের কালো আখ এই প্রেক্ষাপটে নতুন আশার আলো জ্বালাতে পারে। এর দ্রুত বৃদ্ধি, উচ্চ ফলন, বাজারে ভালো দাম এবং বহুমুখী ব্যবহার কৃষকদের আবারও আখ চাষে ফিরিয়ে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জাতের আখ থেকে ভবিষ্যতে জৈব চিনি, প্রাকৃতিক রস ও প্রসেসড পানীয় উৎপাদন সম্ভব, যা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানিতেও লাভজনক হতে পারে। সরকারি কৃষি বিভাগ যদি এই জাতের বীজ ও প্রশিক্ষণ সরবরাহে উদ্যোগ নেয়, তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আখ চাষ আবারও লাভজনক খাতে পরিণত হতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন