কয়েক বছর আগেও ধারণা করা হতো বাংলাদেশের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। বছরের সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহও সেই সময়েই দেখা যেত। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে সেই ধারণা বদলেছে। এখন আর গরম শুধু গ্রীষ্মকালে সীমাবদ্ধ নেই। বর্ষাকালের মধ্যেও দিনের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে জুন-জুলাই মাসেও। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা গত তিন দশকে আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বর্ষায়ও উষ্ণতম দিন : বাংলাদেশের আবহাওয়া মূলত ছয়টি ঋতু নিয়ে গঠিত হলেও কার্যত চারটি মৌসুমই প্রকটভাবে অনুভূত হয়। এগুলো হলো- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এবং শীত। এর মধ্যে গ্রীষ্মকাল সাধারণত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ধরা হয়। তবে এখন গ্রীষ্মের সময়কাল কিছুটা বাড়ছে। গরমের প্রভাব টেনে নিয়ে যাচ্ছে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত। ফলে বর্ষাকালেও স্বাভাবিকের তুলনায় গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এই পরিবর্তনের মূল কারণ জলবায়ুর ধরণে পরিবর্তন। অতীতে জুন মাসে মাঝারি বা ভারি বৃষ্টি হতো, সঙ্গে থাকত মেঘলা আকাশ। এখন দেখা যাচ্ছে, জুন-জুলাইতেও খরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, দীর্ঘদিন বৃষ্টি হচ্ছে না, আকাশ পরিষ্কার থাকছে, সূর্যের তাপ সরাসরি পড়ছে। ফলে এই সময়টিও গরম অনুভূত হচ্ছে।
জলবায়ু ঝুঁকিতে শীর্ষে বাংলাদেশ : জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, বরং এটা এখন বর্তমানের বাস্তবতা। জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এবৎসধহধিঃপয-এ প্রকাশিত ডড়ৎষফ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী অনুযায়ী, বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষ দশে রয়েছে। এর মানে হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে বা পড়তে পারে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। এই ঝুঁকির কিছু সরাসরি প্রভাব দেখা যাচ্ছে দেশের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরন, কৃষি, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনা বৃদ্ধিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকালে সময়মতো বৃষ্টি হচ্ছে না, কখনো অনেক বেশি হচ্ছে, আবার কখনো দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি একেবারেই থাকছে না। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, রোগবালাই বাড়ছে এবং জনস্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
জনজীবনে প্রভাব : তাপমাত্রা বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও দৈনন্দিন জীবনে। বিশেষ করে শহর এলাকায় ঘনবসতি, কংক্রিট-বিল্ডিং নির্মাণ এবং গাছপালা কম থাকার কারণে গরম আরও বেশি অনুভূত হয়। এতে করে হিট স্ট্রোক, পানিশূন্যতাসহ নানান রোগ বাড়ছে। কৃষি খাতে এই পরিবর্তনের প্রভাব আরও স্পষ্ট। বর্ষাকালের চাষাবাদে নির্দিষ্ট সময়মতো বৃষ্টির প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখন সেই নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি না থাকায় কৃষকরা সমস্যায় পড়ছেন। আবার কখনো বৃষ্টি বেশি হলে খেত ডুবে যাচ্ছে, ফসল নষ্ট হচ্ছে।
এ ছাড়া শহরে এবং গ্রামে দুই জায়গাতেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। গরমের সময় বিদ্যুৎচাহিদা বাড়ে, কিন্তু উৎপাদন সেই অনুপাতে না বাড়লে লোডশেডিং হয়। এতে করে গরম আরও কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।
প্রস্তুতি ও করণীয় : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। তবে এই পরিবর্তনের প্রভাবকে কমিয়ে আনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি ও করণীয় রয়েছে, যেগুলো এখন থেকেই কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সবুজায়ন বাড়াতে হবে : শহর ও গ্রামে গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে উষ্ণতা দ্রুত বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১০০ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং আশপাশের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি পর্যন্ত কমাতে পারে। তাই নগরায়ণের পাশাপাশি ‘ইউরবান ফরেস্ট’ গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রতিটি নতুন গৃহায়ন প্রকল্পে খোলা জায়গা ও গাছপালার জন্য জায়গা বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
জলবায়ু সহনশীল কৃষি : খরাপ্রবণ এলাকায় খরা সহনশীল ধানের জাত, জলাবদ্ধ এলাকা বা অতিবৃষ্টির জন্য উপযোগী জাত চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার’ পদ্ধতি শেখানো দরকার, যাতে কম পানি ও কম রাসায়নিক ব্যবহার করে অধিক ফলন নিশ্চিত করা যায়।
নগর পরিকল্পনা : নগর পরিকল্পনায় জলবায়ুর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। শহরের রাস্তায় রিফ্লেক্টিভ পেইন্ট ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, খোলা জায়গার সংরক্ষণ এবং দালান নির্মাণে পরিবেশবান্ধব নকশার ব্যবহার বাড়াতে হবে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন : বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। অতিরিক্ত গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে, তাই সৌরবিদ্যুৎ বা বায়ুশক্তির মতো উৎসে বিনিয়োগ জরুরি। ছোট ছোট সৌর প্যানেল প্রকল্প গ্রামে বা স্কুলে স্থাপন করা গেলে তা অনেকটা চাপ কমাতে পারে।
সচেতনতা : সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তথ্যপ্রবাহ সীমিত হওয়ায় অনেকেই সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করতে পারেন না। স্কুল পর্যায় থেকেই জলবায়ুবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। পাশাপাশি গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল জীবনযাপনের চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, তাই প্রস্তুতিও হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং পরিকল্পিত। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী সংকট হয়ে উঠতে পারে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন